‘“বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিভিন্ন কোর্সের ভাইভার আগে বন্ধুদের কাছ থেকে জুতা, শার্ট ধার করতাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের এডি পদে লিখিত পরীক্ষায় পাস করে ভাইভার জন্য ডাক পড়লে ফরমাল শার্ট, প্যান্ট ও জুতা কোথায় পাব—এই নিয়ে চিন্তায় পড়ি। কারণ, ফরমাল পোশাক কেনার মতো সামর্থ্য ছিল না। ভাইভার কয়েক দিন আগে মা তাঁর কানের দুলজোড়া খুলে হাতে দিয়ে বলেছেন, “বাবা, এটা বন্ধক রেখে তোর ভাইভার পোশাক কিনে নে।” আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ছিল। ভাইভা বোর্ডে ঢোকার সময় মায়ের খালি কান দুটো ভেসে উঠছিল।’—কথাগুলো বলছিলেন এবার বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক (এডি) পদে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত সুব্রত মণ্ডল। মেধাতালিকায় ৫৬তম হয়েছেন তিনি।
সফলতার পথটা মসৃণ ছিল না সুব্রত মণ্ডলের। দিনমজুর বাবা ও গৃহিণী মায়ের সংসারে বড় বাধা ছিল দারিদ্র্য। এসএসতিতে জিপিএ–৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর পেয়ে যান ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তি। সেই টাকায় পড়াশোনা করে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ–৫ পাওয়ার আবার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তির জন্য মনোনীত হন। উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তি ও টিউশনির টাকায় পড়াশোনা করে সিজিপিএ ৩.৬৯ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২০ সালে স্নাতক পাস করেন তিনি।
সুব্রত মণ্ডলকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। সে ভালো ছাত্র এবং ভালো মানুষ। শুধু লেখাপড়া নয় আবৃত্তি, উপস্থাপনা ও নাচেও পারদর্শী। সব সময় তাকে উৎসাহ দিতামরসময় সরকার, প্রভাষক, দ্বারিয়াপুর ডিগ্রি কলেজ
সুব্রত মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এডি পদে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আগে গত অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকায় ঠিকমতো প্রস্তুতি নিতে পারিনি। একজনের মাধ্যমে ঢাকা থেকে কুরিয়ারে আগের বছরের প্রশ্নব্যাংক কিনে পড়াশোনা করি। কোনো কোচিং করিনি। গত ২৩ মে ফলাফলের তালিকায় নিজের রোল নম্বর দেখার পর আমার হাত–পা কাঁপা শুরু করে। মাকে ফোন করে কেঁদে বলেছি, মা আমার চাকরি হয়ে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। মা-ও কেঁদে ফেলেন, পাশে থেকে বাবাও কাঁদেন, বোনও কাঁদে। এ কান্না আমার পরিবারের সংগ্রামের কান্না।’
মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলায় বাড়ি সুব্রত মণ্ডলের। চর মহেশপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং দ্বারিয়াপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। আজকের সফলতার পেছনে দ্বারিয়াপুর ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক রসময় সরকারের অনেক অবদান বলে জানান সুব্রত।
নিউ বিশ্বাস জুয়েলার্সের মালিক কুমার বিশ্বাস বলেন, বন্ধক রাখা জিনিসপত্রে এক হাজারে মাসে ৪০ টাকা করে সুদ নেওয়া হয়। সুব্রত মণ্ডল তাঁর মায়ের কানের দুল এখানে বন্ধক রেখে ১০ হাজার টাকা নিয়েছেন।
রসময় সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভালো ছাত্র অনেক দেখা যায়, কিন্তু ভালো মানুষ তেমন দেখা যায় না। সুব্রত মণ্ডলকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। সে একজন ভালো ছাত্র এবং ভালো মানুষ। শুধু লেখাপড়া নয় আবৃত্তি, উপস্থাপনা ও নাচেও পারদর্শী সে। সব সময় তাকে উৎসাহ দিতাম। তার সফলতায় আমি গর্বিত।’
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে সুব্রত মণ্ডলের সহপাঠী ছিলেন আকাশ চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, ‘সুব্রত মণ্ডল ও আমি হলে একই রুমে থাকতাম। তাঁর জীবনসংগ্রাম খুব কাছ থেকে দেখেছি। তিন থেকে চারটা টিউশনি করাত। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় পরীক্ষার আগের রাতেও টিউশনি করাতে দেখেছি তাকে। পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা করেছে ভালোভাবে। তার সিজিপিএ অনেক ভালো। নিজের পড়াশোনার খরচ জোগানোর পাশাপাশি সুব্রত তার বোনেরও পড়াশোনার খরচ দিত।’
মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার শেষ প্রান্তের আমলসার গ্রামে সুব্রত মণ্ডলের জন্ম। এই গ্রাম থেকে ঝিনাহদহ জেলার শৈলকুপা কাছে। শৈলকুপার লাঙ্গলবাঁধ বাজারে নিউ বিশ্বাস জুয়েলার্স নামের একটি দোকানে ১০ হাজার টাকায় মায়ের কানের দুল বন্ধক রাখেন সুব্রত। সেই টাকা নিয়ে এসে রাজধানীর এলিফেন্ট রোড থেকে ছয় হাজার টাকায় রেডিমেড ফরমাল পোশাক কেনেন।
নিউ বিশ্বাস জুয়েলার্সের মালিক কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্ধক রাখা জিনিসপত্রে এক হাজারে মাসে ৪০ টাকা করে সুদ নেওয়া হয়। এই শর্তে অনেকে বিভিন্ন প্রয়োজনে স্বর্ণের জিনিসপত্র আমার দোকানে বন্ধক রাখেন। সুব্রত মণ্ডল তাঁর মায়ের কানের দুল এখানে বন্ধক রেখে ১০ হাজার টাকা নিয়েছেন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক পদে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের আগামী আগস্ট মাসে যোগদানের কথা রয়েছে। সুব্রত মণ্ডলের ইচ্ছা, প্রথম মাসের বেতন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানে বন্ধকের টাকা ফেরত দিয়ে দুল বাড়িতে নিয়ে গিয়ে নিজ হাতে মায়ের কানে পরিয়ে দেবেন।