৪৩তম বিসিএস প্রজ্ঞাপনে কেন বাদ পড়লেন ২২২ জন, জানেন না কেউ
৪৩তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য প্রথম দফায় যাঁদের প্রজ্ঞাপনভুক্ত করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ১৬৮ জনের নাম বাদ দিয়ে নতুন করে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।
গত বছরের ১৫ অক্টোবর প্রথম দফায় ৯৯ জনকে বাদ দিয়ে প্রজ্ঞাপনে দিয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তখন যাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছিল, এর মধ্যে ৪৫ জন স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অংশ নেননি। আর বাকি ৫৪ জন বাদ পড়েছিলেন। আর প্রথম প্রজ্ঞাপন থেকে কাটছাঁট করে আরও ১৬৮ জনকে বাদ দিয়ে ৩০ ডিসেম্বর দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে এই বিসিএসে সব মিলিয়ে মোট ২২২ জন উত্তীর্ণ হয়েও পিএসসির সুপারিশ পেয়েও বিভিন্ন ক্যাডারের চাকরিতে যোগদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁরা অনেকে ক্ষোভ ও হতাশার কথা জানিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রথম দফার প্রজ্ঞাপনে নাম থাকায় তাঁদের পুরোনো চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। বাদ পড়াদের অনেকেই মনে করছেন তাঁরা ‘কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর খামখেয়ালিপনার’ শিকার হয়েছেন।
বিসিএস পরীক্ষা ও যাচাই–বাছাইয়ের সব ধাপ শেষে সরকার উত্তীর্ণদের চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে থাকে। প্রজ্ঞাপন প্রকাশের আগে পুলিশ ভেরিফিকেশনে প্রায় প্রতিবছরেই অল্পসংখ্যক হলেও বাদ পড়ে আসছে। কিন্তু প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত হওয়ার পর ফৌজদারি অপরাধ না করলে বাদ পড়ার ঘটনা বিরল। কারণ, চূড়ান্তভাবে যাঁদের নাম প্রজ্ঞাপন থাকে, তাঁরাই চাকরিতে যোগ দেন।
বাদ পড়া চাকরিপ্রত্যাশীরা যা বলছেন—
একটি বিসিএস পরীক্ষার সব ধাপ পেরোনোর পর পুলিশি তদন্ত শেষে নিয়োগ পাওয়ার পর এত বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় দফায় প্রজ্ঞাপন প্রকাশের ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন’ ও ‘একটি রেকর্ড’ বলে বর্ণনা করছেন অনেকে। একই সরকারের আমলে একবার চাকরির জন্য মনোনীত করে পরে কেন আবার তাঁকে বাদ দেওয়া হলো—এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা–সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তবে, কেন এতজনকে বাদ দেওয়া হলো, সে সম্পর্কে নতুন প্রজ্ঞাপনে কিংবা আলাদা করে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি সরকার।
ঝিনাইদহের শৈলকুপার মেয়ে মোছা. নাসরিন সুলতানা প্রথম প্রজ্ঞাপনে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তৃতীয়বারের মতো বিসিএস দিয়ে এবারই প্রথমবারের মতো উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। বিবিসি বাংলাকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারে কেউ পড়ালেখাই জানে না। আমি গ্রামের প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েট। প্রথম বিসিএস গেজেটেড। আমাদের সবাই কৃষিকাজ করে। বিভিন্ন এনজিওর স্কলারশিপ নিয়ে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করেছি। আমার কেন এই ক্ষতি করা হলো?’
নাসরিন সুলতানা জানান, তিনি একটি বেসরকারি চাকরি করতেন। প্রথমবার প্রজ্ঞাপনভুক্ত হওয়ার পর বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দেবেন বলে সেই চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা গরিব মানুষ। বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। আমার তিন বোন। ভাই নাই। বড় আপা কষ্ট করে পড়ালেখা করেছেন। মা ১০ বছর ধরে অসুস্থ। মা–বাবা কান্না করছেন। কোনোভাবেই এই অন্যায় তাঁরা মানতে পারছেন না।’
৪৩তম বিসিএসের সব শেষ প্রজ্ঞাপন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে নানা আলোচনা।
কাস্টমস ক্যাডারে নিয়োগের জন্য গেজেটভুক্ত হয়েও নতুন গেজেটে বাদ পড়েছেন, এমন একজন কথা বলেছেন বিবিসি বাংলার সঙ্গে। নিজের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, তিনি তিনবার গণিত অলিম্পিয়াডে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। শীর্ষ পর্যায়ে ছিলেন ফিজিক্স অলিম্পিয়াডেও। বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে ভারতে বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন।
রাজউক উত্তরা মডেল থেকে এইচএসসি পাসের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক’ ইউনিটে তৃতীয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক’ ইউনিটে ১০ম ও বুয়েটে ২০৩ম হয়েছিলেন। পরে বুয়েটে পড়েন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইবিএ থেকে এমবিএ করেছেন। বুয়েটে ডিনস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তিনি বলেন, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপসহ অফার ছিল, কিন্তু যেতে পারিনি। বিসিএস দিয়ে চাকরি পেলাম ও গেজেটভুক্ত হলাম। সেখান থেকে আমাকে বাদ দেওয়া হলো। রাজনীতি করিনি কখনো। কারও তো ক্ষতিও করিনি—হতাশ কণ্ঠে বলছিলেন তিনি।
বরিশালের বাকেরগঞ্জ থেকে এবার নিয়োগ পেয়েছিলেন নয়জন। এর মধ্যে দ্বিতীয় গেজেটে নাম নেই তিনজনের। এই তিনজনের মধ্যে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া একজন জানান তাঁর মা ক্যানসারের রোগী। তিনি বলেন, ‘এই চাকরির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিন, আমি বা আমার পরিবারের কেউ কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। কখনো আইন ভঙ্গের মতো কোনো কাজও করিনি। আমি কেন অন্যায়ের শিকার হব?’
গাইবান্ধা জেলার যতজন নিয়োগ পেয়েছিলেন, প্রথম গেজেটের মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে চারজনকে দ্বিতীয় গেজেটে রাখা হয়নি। এর মধ্যে একজন প্রশাসন ও অন্য তিনজন শিক্ষা ক্যাডারের। এই তিনজনের একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এম এ হান্নান সরকার। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটাই আমার শেষ বিসিএস ছিল। আমি জানতে চাই, কেন একবার নিয়োগ পেয়েও আবার বাদ পড়লাম।’ তাঁর দাবি, তিনি বা তার পরিবারের কেউ কখনো রাজনীতি করেননি।
বিশ্লেষকেরা যা বলছেন—
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘সব কিছু যাচাই–বাছাই করেই প্রথম দফায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্ম, এলাকা, লিঙ্গ, বর্ণ বা রাজনৈতিক মতের কারণে কাউকে বাদ দেয়া ‘ভয়াবহ অন্যায়’। এত ধাপ ও বাছাইপ্রক্রিয়া পেরিয়ে এত বড় সংখ্যা বাদ পড়ার ঘটনা দুঃখজনক। এটা কেন হবে? এটা রাষ্ট্রযন্ত্রেরই একটা দুর্নীতি। যদি কোনো বিশেষ কারণে কাউকে বাদ দিতে হয়—সেটি সুস্পষ্ট করে বলা উচিত। নিয়োগে স্বচ্ছতা জরুরি।’ এই শিক্ষকের মতে, প্রশ্নপত্র ফাঁস কিংবা বিশেষ কোনো ফেভার পাওয়ার ঘটনা কিংবা কেউ কোনো অপরাধে জড়ালে তাঁকে বাদ সরকার দিতে পারে, কিন্তু সেটি দেশবাসীকে জানাতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেকজন শিক্ষক শারমিন আহমেদ বলেন, একবার গেজেটভুক্ত হওয়ার পর ফৌজদারি অপরাধ ছাড়া কিংবা কারণ দর্শানো ছাড়া এভাবে বঞ্চিত করার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তরুণদের ওপর। তাঁর মতে, এটি শিক্ষার্থীদেরও পড়াশোনার স্পৃহাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তিনি জানান, প্রথমবার পরীক্ষা ও যাচাই–বাছাই শেষে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের সবাইকেই চাকরিতে রাখা উচিত, যদি না কারও বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অপরাধ কিংবা আইন ভঙ্গের অভিযোগ না পাওয়া যায়। নয়তো স্বচ্ছতা, আইনের শাসন ও পিএসসির কাজের যে প্রক্রিয়া, সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাঁর মতে, এভাবে ইচ্ছেমতো যাঁকে খুশি বাদ দেওয়ার সংস্কৃতিটা যাঁরা বাদ গেল শুধু তাঁদের জন্যই নয়, বরং যাঁরা চাকরি করছেন, তাঁদের জন্যও এটা অশনিসংকেত। কারণ, ব্যক্তি ইচ্ছায় যে কেউ চাকরি হারাতে পারেন। সব মিলিয়ে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এটি অস্থিরতা বাড়িয়ে দেবে এবং মেধাবীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করবে।
মন্তব্য নেই পিএসসি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের
সরকারি কর্মকমিশন বা পিএসসির একাধিক সদস্যের সঙ্গে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বক্তব্যের পাওয়া যায়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকেও।
পিএসসি ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর। এরপর আবেদন, প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভাসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৪৩তম বিসিএস থেকে ২ হাজার ৮০৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল পিএসসি। এরপর যাচাই–বাছাই শেষে গত ১৫ অক্টোবর ২০৬৪ জনকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দিয়ে প্রথম গেজেট প্রকাশ করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপরই এই গেজেটে যাঁদের নাম ছিল, তাঁদের চাকরিতে যোগদানের কথা। কিন্তু ৩০ ডিসেম্বর নতুন করে আরও ১৬৮ জনকে বাদ দিয়ে মোট ১ হাজার ৮৯৬ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হলো।
**বিবিসি বাংলা ১ জানুয়ারি ২০২৫ সালে এই প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। প্রথম আলোর পাঠকের জন্য এটি ইষৎ সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশ করা হলো।