চাকরির পরীক্ষার কেন্দ্রে শুনতে হয় পরীক্ষা স্থগিত, অর্থ–সময় অপচয়ের দায় কার
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদের চাকরির পরীক্ষা দিতে শুক্রবার সকালে পঞ্চগড় থেকে এক হাজার টাকা বাসভাড়া দিয়ে ঢাকায় আসেন মো. আল আমিন হক। গাবতলীতে বাস থেকে নামার পর শান্তিনগরে পরীক্ষার কেন্দ্রে যাওয়ার উদ্দেশে আবার বাসে ওঠেন। শান্তিনগর মোড়ে নেমে একটি খাবার দোকানে বসে বিশ্রাম নেন। নাশতা সেরে হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজ কেন্দ্রে যান পরীক্ষা দিতে। কিন্তু কেন্দ্রে গিয়ে শোনেন পরীক্ষা স্থগিত।
মো. আল আমিন হক বলেন, ‘টিউশনির টাকা জমিয়ে প্রতিবার পরীক্ষা দিতে ঢাকায় আসি। একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে ঢাকায় আসার আগে কয়েকবার ভাবতে হয়। আসা-যাওয়ার বাসভাড়া ও থাকা-খাওয়া মিলে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা লাগে। বেকারদের টাকা শেষ হয় আবেদন আর পরীক্ষার জন্য আসা–যাওয়া করতে করতে। কষ্ট করে টাকা খরচ করে এসে এখন খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে। আমার টাকা কি মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ফেরত দেবে?’
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ও ডে-কেয়ার ইনচার্জ পদের বাছাই পরীক্ষা শুক্রবার বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ নির্ধারিত ছিল। নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী চাকরিপ্রার্থীরা সকাল ১০টায় পরীক্ষা দিতে কেন্দ্রে গিয়ে শোনেন, পরীক্ষা হবে না। সাড়ে ১০টার দিকে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয় অনিবার্য কারণে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এ ঘটনার পর বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে বিক্ষোভ করেন প্রার্থীরা।
টিউশনির টাকা জমিয়ে প্রতিবার পরীক্ষা দিতে ঢাকায় আসি। একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে ঢাকায় আসার আগে কয়েকবার ভাবতে হয়। আসা-যাওয়ার বাসভাড়া ও থাকা-খাওয়া মিলে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা লাগে। বেকারদের টাকা শেষ হয় আবেদন আর পরীক্ষার জন্য আসা–যাওয়া করতে করতে। কষ্ট করে টাকা খরচ করে এসে এখন খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে। আমার টাকা কি মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ফেরত দেবে?’
শুধু মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরই নয়, গত বছরের ২১ অক্টোবর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ১০টি পদের লিখিত পরীক্ষাও শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয়। সে সময় পরীক্ষা শুরুর দেড় ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। পরে বিমান কর্তৃপক্ষ পরীক্ষাটি স্থগিত ঘোষণা করে। পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে গিয়ে ওই পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়টি জানতে পারেন।
এ ছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তরের ইউনিয়ন সমাজকর্মী পদের নিয়োগ পরীক্ষা ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাতে হঠাৎ স্থগিত করা হয়। পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল পরের দিন। পরীক্ষা দিতে অনেকে ঢাকায় রওনা দেওয়ার পরে পরীক্ষা স্থগিত হয়। এতে কেউ কেউ ঢাকার বাসে ওঠার পর এ খবর পান। কেউ কেউ ঢাকায় পরীক্ষা দিতে এসে জানতে পারেন স্থগিত হয়েছে।
স্নাতক শেষ করে তিন বছর ধরে চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছেন মো. জাহিদুল ইসলাম। এখন পর্যন্ত ১৮টি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। মো. জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কারণে পরীক্ষা স্থগিত করলে সাধারণত প্রতিষ্ঠানগুলো তিন থেকে চার দিন আগে খুদেবার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের পরীক্ষা ছিল শুক্রবার বেলা ১১টায়। পরীক্ষা স্থগিতের খুদে বার্তা দিয়েছে সাড়ে ১১টায়। অথচ পরীক্ষার্থীরা তো ফোন নিয়ে পরীক্ষা দিতে যান না। অধিদপ্তরের এমন খামখেয়ালিপনায় কয়েক হাজার চাকরিপ্রার্থীকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
কোনো ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ পরীক্ষা স্থগিত করার প্রতিবাদে হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজ, তেজগাঁও কলেজ ও তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়সহ কয়েকটি কেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ করেন চাকরিপ্রার্থীরা। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। চাকরিপ্রার্থীরা প্রশ্নপত্র ফাঁসেরও অভিযোগ তোলেন।
একরামুল নামের আরেকজন চাকরিপ্রার্থী বলেন, ‘নীতিনির্ধারকেরা এসি রুমে বসে কখনো বেকারদের কষ্ট বুঝবেন না। একটা চাকরির পরীক্ষা না হওয়া মানে একজন বেকারের স্বপ্ন ভঙ্গ। নীতিনির্ধারকেরা যদি এ বিষয়টি বুঝতেন, তাহলে বেকারদের সঙ্গে এভাবে তামাশা করতে পারতেন না। শেষ মুহূর্তে পরীক্ষা স্থগিত করতেন না। বেকারদের সঙ্গে এমন তামাশা করা বন্ধ হোক, নইলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক।’
অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ও ডে-কেয়ার ইনচার্জ পদের বাছাই পরীক্ষা শুক্রবার বেলা ১১টায় ঢাকার ২০টি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কেন্দ্রে কেন্দ্রে মাইকে পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেওয়ার পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে পরীক্ষা স্থগিতের তথ্য জানানো হয় এবং প্রার্থীদের মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হয়।
পরীক্ষা যে কারণেই স্থগিত করা হোক না কেন, নিয়োগ পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁদের মনে রাখা দরকার, এ ধরনের একটি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অনেক প্রার্থীকে ঢাকার বাইরে থেকে টাকা খরচ করে আসতে হয়। সুতরাং নিয়োগকর্তাদের উচিত, এ ক্ষেত্রে দায় স্বীকার করে নেওয়া এবং প্রত্যেক প্রার্থীর মোবাইল অ্যাকাউন্টে ‘টোকেন মানি’ হিসেবে এক হাজার টাকা ফেরত দেওয়া। প্রয়োজনে আইন করে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা উচিত।তারিক মনজুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও পিএসসির পরীক্ষক
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের পরিচালক ও বিভাগীয় নির্বাচন কমিটির সভাপতি মনোয়ারা ইশরাত স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীন বেলা ১১টায় অনুষ্ঠেয় অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ও ডে-কেয়ার ইনচার্জ পদের বাছাই/নির্বাচনী পরীক্ষা অনিবার্য কারণবশত স্থগিত করা হলো। পরে পরীক্ষার তারিখ এবং সময় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে জানানো হবে।
শেষ মুহূর্তে পরীক্ষা স্থগিতের কারণ জানতে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীনের মুঠোফোনে শুক্র ও শনিবার ফোন দেওয়া হলে দুই দিনই ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। কমিটির সভাপতি মনোয়ারা ইশরাতের মুঠোফোনে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও উত্তর দেননি তিনি।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক (পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন) আয়শা সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিয়োগ কমিটিতে ছিলাম না। কী কারণে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে, সেটা আমার জানা নেই।’
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ও ডে-কেয়ার ইনচার্জ পদের বাছাই পরীক্ষা শুক্রবার বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ নির্ধারিত ছিল। নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী চাকরিপ্রার্থীরা সকাল ১০টায় পরীক্ষা দিতে কেন্দ্রে গিয়ে শোনেন, পরীক্ষা হবে না। সাড়ে ১০টার দিকে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয় অনিবার্য কারণে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) পরীক্ষক তারিক মনজুর বলেন, ‘আকস্মিকভাবে পরীক্ষা স্থগিতের পেছনে নানা কারণ থাকে। সাধারণত প্রশ্ন ফাঁস হলে এবং ব্যাপারটি আগেই ধরা পড়লে শেষ মুহূর্তে এসে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তবে যে কারণেই স্থগিত করা হোক না কেন, নিয়োগ পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁদের মনে রাখা দরকার, এ ধরনের একটি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অনেক প্রার্থীকে ঢাকার বাইরে থেকে টাকা খরচ করে আসতে হয়। সুতরাং নিয়োগকর্তাদের উচিত, এ ক্ষেত্রে দায় স্বীকার করে নেওয়া এবং প্রত্যেক প্রার্থীর মোবাইল অ্যাকাউন্টে “টোকেন মানি” হিসেবে এক হাজার টাকা ফেরত দেওয়া। প্রয়োজনে আইন করে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা উচিত।’