৪৪তম বিসিএস ভাইভায় সাধারণ কিছু দিক: কী করবেন, কী করবেন না
৪৪তম বিসিএসের ভাইভা শুরু হয়েছে। ছয়টি বোর্ডের মাধ্যমে এই বিসিএসের ভাইভা নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি ৪৪তম বিসিএসের ভাইভা পরীক্ষার তারিখ ও শিডিউল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। প্রথমে সাধারণ ক্যাডারের প্রার্থীদের ভাইভা নেওয়া হবে। এই বিসিএসে পাস করেছেন ১১ হাজার ৭৩২ জন। এই বিসিএসের ভাইভায় কী করতে পারেন, তা নিয়ে কিছু আলোচনা করছি।
ক. বিগত কয়েকটি বিসিএসের ভাইভার অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, ভাইভা অনুষ্ঠানের ক্রম হলো প্রথমে সাধারণ ক্যাডার, তারপর বোথ ক্যাডার এবং শেষে কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডার।
খ. ভাইভায় সর্বমোট নম্বর হলো ২০০ এবং এই নম্বরের মধ্যে কোনো উপবিভাগ নেই। ২০০ নম্বরের মধ্যে যদি আপনি শতকরা ৫০ ভাগ নম্বর, মানে ১০০ পান, তবে পাস করেছেন। এতে ক্যাডার আসবে কি না, বলা যায় না। তবে নন-ক্যাডার লিস্টে নাম থাকবে—এটা নিশ্চিত! এতে পরে হয়তো অন্য কোনো সরকারি চাকরিতে আপনি সুপারিশকৃত হতে পারেন।
গ. সাধারণত নির্ধারিত দিনে সকাল ১০টায় ভাইভা শুরু হয়। আপনাকে ৩০ মিনিট আগে যেতে হবে। নিচতলার একটা বড় কক্ষে সবাইকে জড়ো করা হয়। তারপর অফিস সহায়ক এসে নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রেশন ধরে কাঙ্ক্ষিত বোর্ডে নিয়ে যাবেন। এখানে মনে রাখা দরকার, বোর্ড সিলেকশন করা হয় এলোপাতাড়ি এবং ওই দিন সকালেই। সুতরাং কোনো ধরনের অসমতা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর সাধারণত প্রতি বোর্ডে ১৬ জন প্রার্থী প্রতিদিন ভাইভা দেন।
ঘ. যাঁর বোর্ডে ভাইভা দেবেন, তাঁর অফিস সহকারী কক্ষে ঢোকার আগেই আপনার কাগজপত্র নিয়ে নেবেন। শুধু মূল কিছু সনদ নিয়ে আপনি ভেতরে যাবেন।
ঙ. বোর্ডের ধরন দুটি। একটি প্রেসিডেনশিয়াল এবং অন্যটি সাধারণ ভাইভা বোর্ড। প্রেসিডেনশিয়াল বোর্ডে পিএসসির চেয়ারম্যানসহ সব সদস্য থাকেন। এটা প্রথম কয়েক দিন চলে। আর সাধারণ বোর্ডে পিএসসির প্রত্যেক সদস্য চেয়ারম্যান হন ও দুজন বাইরের এক্সপার্ট থাকেন। অর্থাৎ, তিনজন মিলে বোর্ড গঠিত হয়।
চ. সাধারণ অর্থে মোট বোর্ড হয় ১৫টি। কারণ, চেয়ারম্যানসহ পিএসসির সদস্যসংখ্যা সর্বোচ্চ ১৫।
ছ. কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারের ভাইভার সময় সাধারণত সাবজেক্ট এক্সপার্ট থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেশি আমন্ত্রণ করা হয়। তাই প্রস্তুতি ভালো নিতে হবে।
জ. ২৭তম বিসিএস থেকে থেকে বোর্ডের সামনে আপনার লিখিত পরীক্ষার নম্বর থাকে না। অর্থাৎ, আপনাকে মূল্যায়ন করা হবে শুধু ২০০ নম্বরের ওপর। আগে কী করেছেন এবং ভবিষ্যতে কী করবেন, তা বিবেচ্য বিষয় না।
ঝ. আপনি বোর্ড থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্দিষ্ট স্থানে চেয়ারম্যান সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে নম্বর দিয়ে দেন। এটি পরে করা হয় না।
ঞ. পোশাক ছেলেরা স্যুট-টাইসহ ফরমাল পরবেন। সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট উত্তম। জুতো কালো রং হওয়াই ভালো। ফিতাওয়ালা অক্সফোর্ড শু হলে আরও ভালো। মেয়েরা মানানসই শাড়ি পরবেন। ভেতরে ভালো মানের এসি আছে বিধায় গরম ও পোশাকের মধ্যে সংঘর্ষ হবে না।
ট. কেউ চাইলে টুপি, পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেও যেতে পারেন। তবে দেখেছি, যাঁরা খুব ধার্মিক, তাঁরা এমন পোশাক পরেন। এতে কোনো অসুবিধা নেই।
ঠ. পুরুষ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে চুল আদর্শ মান পর্যন্ত ছেঁটে রাখা উচিত। পরিচ্ছন্নতা আপনার রুচির পরিচায়ক। মেয়েদের ক্ষেত্রেও আদর্শ মান বজায় রাখা উচিত।
ড. কক্ষে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় যথেষ্ট সতর্ক থাকবেন। সাধারণ আদর্শগুলো মেনে চলবেন। যেমন অনুমতি নেওয়া, সালাম দেওয়া, নম্রভাবে হাঁটা ইত্যাদি সহজ কাজ। কিন্তু অনেকেই ভুলে যান।
ঢ. বোর্ডে যে ধর্মের লোকই থাকুক, মুসলিম প্রার্থী সালাম দেবেন, হিন্দু প্রার্থী নমস্কার দেবেন এবং অন্য ধর্মের প্রার্থীরা নিজের রীতি মেনে বলবেন। কারণ, আপনি বোর্ডের সবার ধর্ম সম্পর্কে জানেন না।
ণ. সালাম তিনজনকেই দেবেন না। শুধু বোর্ডের সভাপতিকে লক্ষ্য করে একবার দেবেন।
ত. সাধারণত গড়ে ২০ মিনিটের মতো আপনাকে বোর্ডের সামনে থাকতে হতে পারে। আমার জানামতে, ৩৪তম বিসিএসে একজনকে ৪৫ মিনিট রেখেছিল। তবে এটা ব্যতিক্রম। ভয়ের কিছু নেই।
থ. বোর্ডের চেয়ারম্যান বা সদস্য নারী হলেও স্যার সম্বোধন করবেন। আর পুরুষদের তো স্যার বলবেনই।
দ. আপনার গলার স্বর কখনো অধিক উচ্চ বা অধিক নিম্ন হবে না। আদর্শ মান বজায় রেখে কথা বলবেন। ৩৫তম বিসিএসে এক প্রার্থী জোরে সালাম দেওয়ায় বোর্ড রেগে গিয়েছিল। আরেকটা বিষয়, কথা বলার গতি খুব দ্রুত বা ধীর যেন না হয়। এতে বিরক্ত হন অনেকে। কথার মাঝখানে ‘অ্যা’, ‘হুম’, ‘উহ্’ উচ্চারণ করা যাবে না।
ধ. বাংলা প্রশ্ন বাংলায় উত্তর, ইংরেজি প্রশ্ন ইংরেজিতে উত্তর এবং ইংরেজি-বাংলা মিশ্রিত প্রশ্নের উত্তর মিশিয়েই দেবেন।
ন. যদি বাংলায় কথা বলেন, কোনোভাবেই ইংরেজি শব্দ টেনে আনবেন না। এতে সমস্যা হতে পারে। তবে টেকনিক্যাল শব্দ ব্যবহার করতে পারেন।
প. অনেক সময় ইংরেজি প্রশ্নের উত্তর বাংলায় দিতে চাইলে অনুমতি নিয়ে নেবেন। বোর্ড অনুমতি দিলেই কেবল বলবেন; অন্যথায় নয়। তবে অনেক বোর্ড বাংলা বলার অনুমতি দেয় না।
ফ. উত্তর খুব সহজ ভাষায় উপস্থাপন করুন। পারলে পয়েন্ট আকারে বলবেন। একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, যা জিজ্ঞাসা করল, তার বেশি বলতে যাবেন না।
ব. একটা কথা মনে রাখবেন, বোর্ড আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। আপনি বোর্ডকে নিয়ন্ত্রণ করবেন। কীভাবে? ধরুন, আপনার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। তাহলে আপনাকে লালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার সম্ভাবনা অন্যদের চেয়ে বেশি।
ভ. বোর্ড যদি কারও সঙ্গে খুব বেশি আন্তরিকতা প্রকাশ করে, তবে ধরে নেওয়া হয় ইতিবাচক একটা নম্বর আসতে পারে। ‘তুমি’ সম্বোধনও অনেক সময় ইতিবাচক। তবে এটি কোনো প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়!
ম. কথা বলার সময় হাত নাড়াবেন না এবং পা ঝাঁকাবেন না। মাথা প্রয়োজন অনুযায়ী মুভ করবেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসতে যাবেন না।
য. যাঁদের হাত কথা বলার সময় ওপরে উঠে যায়, তাঁরা এক হাতের আঙুল দিয়ে অন্য হাতের আঙুল পরস্পর আটকে রাখবেন। এতে আর হাত উঠবে না!
র. বিসিএস পরীক্ষা বিজ্ঞাপনে যেসব কাগজপত্র নিয়ে ভাইভায় উপস্থিত হতে বলেছে, তা অবশ্যই বিনা ব্যর্থতায় আগেই জোগাড় করে ওই দিন নিয়ে যান।
ল. ২০০-এর মধ্যে কত দিতে পারে, তা বলা খুবই কঠিন। এটা বোর্ড ও আপনার পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করে। ভালো করলে ১৮০-ও দিতে পারে।
শ. ভাইভায় ফেল বা কম নম্বর পাওয়ার প্রধান কারণ হলো, ১. বেয়াদবি করা, ২. বেশি জানার ভাব করা, ৩. নার্ভাস থাকা, ৪. অসতর্ক আচরণ করা, ৫. উচ্চারণে আঞ্চলিকতা থাকা, ৬. আই কন্ট্রাক্ট না থাকা, ৭. ব্যর্থতা স্বীকার না করা, ৮. সন্তোষজনক উত্তর কম দেওয়া ইত্যাদি।
এই বিষয়গুলো মাথায় থাকলে ভাইভা নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়া বা ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। সবার জন্য শুভকামনা।
লেখক: প্রশাসন ক্যাডার (দ্বিতীয় স্থান), ৩৪তম বিসিএস।