চাকরির মৌখিক পরীক্ষায় কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবেন
চাকরির মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করার জন্য কিছু বিষয়ে মনোযোগী থাকতে হয়। ভাইভা বোর্ডে কী করা যায়, আর কী করা যায় না—এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। কারণ, বিসিএসের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ চাকরির মৌখিক পরীক্ষায় অনেক নম্বর বরাদ্দ থাকে।
সুতরাং শুধু উত্তর জানলেই হয় না, উত্তর দেওয়ার এবং নিজেকে তুলে ধরার কৌশল জানতে হয়। ভাইভা বোর্ডে কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবেন এবং কোন পরিস্থিতিতে কী করবেন, এখানে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
ভাইভা বোর্ডে ঢোকার আগে
অনেকেই ভাইভা বোর্ডে ঢোকার আগে বইপত্র পড়তে থাকেন। কেউ কেউ আবার সাক্ষাৎকার শেষ করে বেরিয়ে আসা প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করেন, কোন কোন প্রশ্ন করা হলো। এ দুটি প্রবণতার কোনোটিই ঠিক নয়। কারণ, বোর্ডে কোন প্রশ্ন করা হবে, তা সাধারণত আগে থেকে ধারণা করা যায় না। তা ছাড়া অন্য প্রার্থীর প্রশ্ন শুনে নিজেকে অস্থির করে তোলারও প্রয়োজন নেই।
ভাইভার জন্য পড়াশোনা যদি করতে হয়, আগেই করতে হবে। আর বোর্ডে কী ধরনের প্রশ্ন করা হয়, তা জানার জন্য আগেই পুরোনো প্রার্থীদের সঙ্গে আলাপ করে নিতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে চাকরি অনুযায়ী ভাইভার গাইড বা বইপত্র পাওয়া যায়। প্রয়োজনে সেগুলোও অনুসরণ করতে পারেন। তবে এ সবই করবেন আগে, মৌখিক পরীক্ষার দিনে নয়।
ভাইভা বোর্ডে ঢোকার সময়
ভাইভা বোর্ডে ঢোকার সময় অবশ্যই অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলায় ‘আমি কি ঢুকতে পারি’ কিংবা এ জাতীয় অন্য কোনো বাক্য বলা ভালো। অনেক সময় বোর্ডের সদস্যরা বেশ দূরে অবস্থান করেন। সে ক্ষেত্রে একটু জোরে আরেকবার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
যথেষ্ট উচ্চস্বরে দ্বিতীয়বার অনুমতি চাওয়ার পরও যদি বোর্ডের কোনো সদস্য অনুমতি না দেন, তবে দরজা ধরেই অপেক্ষা করতে হবে। ঢোকার অনুমতি পেলে বোর্ড সদস্যদের কাছাকাছি যাওয়ার পর সালাম বা আদাব দিতে হবে, কিংবা ‘শুভ সকাল’, ‘শুভ বিকেল’ এ রকম সম্ভাষণ করতে হবে। তাঁরা বসার অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত বসা যাবে না। সাধারণত বসতে চাওয়ার জন্য আলাদা অনুমতি নেওয়ার দরকার হয় না। তবে আপনাকে বসতে বললে বসার আগে অবশ্যই ‘ধন্যবাদ’ জানাবেন।
জরুরি কাগজপত্র সঙ্গে রাখা
ভাইভা বোর্ডে সাধারণত লিখিত পরীক্ষার প্রবেশপত্র এবং অন্যান্য জরুরি কাগজপত্র সঙ্গে রাখতে হয়। এ ছাড়া প্রয়োজনে অন্য কাগজ, যেমন নিজের প্রকাশিত বই বা নিবন্ধ সঙ্গে রাখার প্রয়োজন হয়। কাগজপত্রগুলো এমনভাবে রাখবেন, যাতে যেকোনোটি সহজেই বের করে দেখানো যায়। সাধারণত নিজের কাছেই ফাইল ও অন্যান্য কাগজ রাখতে হয়। কোনো কাগজ দেখতে না চাইলে আগ বাড়িয়ে দেখানোর দরকার নেই। আর একটি ভালো কলম ও সাদা কাগজ সঙ্গে রাখবেন।
পোশাক
মৌখিক পরীক্ষার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরা শাড়ি পরতে পছন্দ করেন। সে ক্ষেত্রে হালকা রঙের সুতি শাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। শাড়ির প্রধান রং সাদা হতে পারে। কানে-হাতে খুবই হালকা গয়না ব্যবহার করা উচিত। শাড়ির সঙ্গে উঁচু স্যান্ডেল ব্যবহার করতে পারেন, তবে সেটি যেন হাইহিল না হয়। মুখে খুব হালকা মেকাপ করতে পারেন। চুল খোলা না রেখে বেণি বা খোঁপা করা যেতে পারে। ছেলেদের ক্ষেত্রে শার্ট-প্যান্ট বেশি ব্যবহার করতে দেখা যায়।
ছেলেরা স্ট্রাইপ করা যেকোনো শার্ট পরতে পারেন। প্যান্টের রং কালো হতে পারে। জিন্সের প্যান্ট কিংবা কেডস না পরাই ভালো। কালো চামড়ার জুতা মোজাসহ পরবেন। বিশেষ প্রয়োজন না হলে কোট ও টাই পরার দরকার নেই। চুল ছোট থাকাই ভালো, তবে তা যেন পরিপাটি করে আঁচড়ানো থাকে। পোশাক অবশ্যই পরিষ্কার ও ইস্তিরি করা থাকবে।
বসা ও কথার ভঙ্গি
চেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা করে বসবেন। হাত রাখবেন কোলের ওপর, কেনোভাবেই টেবিলের ওপর হাত রেখে কথা বলা যাবে না। মাথা নিচু করে রাখা যাবে না। চোখ রাখতে হবে বোর্ড সদস্যদের চোখের দিকে। চশমা ব্যবহার করলে চশমা নিচু করে ওপরের ফাঁক দিয়ে তাকানো যাবে না। যিনি প্রশ্ন করবেন মূলত তাঁর চোখের দিকে তাকিয়েই কথা বলতে হবে।
তবে উত্তর দীর্ঘ হলে অন্যদের দিকেও কমবেশি তাকাতে হবে। কথা বলার সময় বেশি উঁচু গলায় কথা বলা যাবে না। আবার এমন মৃদু স্বরেও বলা ঠিক নয়, যাতে অন্যদের শুনতে সমস্যা হয়। প্রমিত উচ্চারণে কথা বলা দরকার। ভাইভা বোর্ডে পালস একটু দ্রুতই চলে, তাই স্বাভাবিক গতির চেয়ে একটু ধীরে কথা বলতে হয়। হাতে একটি রুমাল রাখতে পারেন। হঠাৎ কাশি এলে রুমালে ঢেকে কাশি দেবেন।
উত্তর পারা না-পারা
উত্তর পারা না-পারার ওপর ভাইভার নম্বর পুরোপুরি নির্ভর করে না। মঙ্গোলিয়ার মুদ্রার নাম কী, কিংবা মরক্কোর রাজধানীর নাম কী, এসব উত্তর না পারলেও ক্ষতি নেই। তবে কোন প্রশ্ন আপনি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন, সেটি বোর্ড সদস্যরা বিশেষভাবে লক্ষ করেন।
বিসিএসসহ অনেক পরীক্ষার বোর্ড সদস্যদের মধ্যে একজন মনোবিদও থাকেন। তিনি আপনার ব্যক্তিত্ব ও মানসিক দৃঢ়তা পর্যবেক্ষণ করেন। সুতরাং উত্তর দেওয়ার সময় আপনার ব্যক্তিত্বের সবল দিকগুলোর প্রকাশ ঘটান, দুর্বল দিকগুলো আড়াল করুন। প্রশ্নের উত্তর যদি সুনির্দিষ্ট এককথায় হয়, আর সেটি যদি আপনার জানা না থাকে, তবে বিনীতভাবে বলুন ‘এটি আমার জানা নেই’। তবে আলোচনার যোগ্য কোনো প্রশ্নই ছেড়ে দেবেন না, অবশ্যই কিছু না কিছু বলার চেষ্টা করবেন।
সাক্ষাৎকার শেষে বেরিয়ে আসা
ভাইভা শেষ করে বেরিয়ে আসার সময় বিশেষভাবে লক্ষ করবেন কোনো কাগজপত্র ফেলে আসলেন কি না। চলে আসার আগে বলিষ্ঠ গলায় ‘ধন্যবাদ’ বলবেন। বেরিয়ে আসার সময় সরাসরি পেছন দিকটা বোর্ড সদস্যদের দিকে ফিরিয়ে চলে আসবেন না। ঢোকার এবং বেরিয়ে আসার সময় আপনার হাঁটার পদক্ষেপ দৃঢ় হবে।
শেষ কথা
সবচেয়ে বড় কথা পুরো সময়টাই আত্মবিশ্বাসী থাকবেন, তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ক্ষতির কারণ হতে পারে। বোর্ড সদস্যরা কোনো বিষয়ে হাসতে পারেন, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আপনার হাসা ঠিক হবে না। তাই বলে পুরো সময়টা একেবারে গুরুগম্ভীর হয়ে থাকারও দরকার নেই।
সাবলীলভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবেন। কোনো বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে কথা থামিয়ে দেবেন না। আবার যে উত্তরটি এক শব্দে দেওয়া যায়, সেটি এক শব্দে না দিয়ে পূর্ণ বাক্যে উত্তর দেবেন। কোনো ধরনের মুদ্রাদোষ থাকলে তা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। জিব দিয়ে অকারণে ঠোঁট ভেজাবেন না।
উত্তর দেওয়ার সময় ভঙ্গি এমন হবে না, যাতে মনে হয় আপনি মুখস্থ বলছেন। প্রয়োজনে কণ্ঠের ওঠানামা ব্যবহার করবেন। আর শেষ কথা হলো নির্ধারিত সময়ের আগেই উপস্থিত থাকবেন। সাক্ষাৎকারের আগে বা পরে উপস্থিতিপত্রে স্বাক্ষর করার প্রয়োজন হতে পারে।
তারিক মনজুর
শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়