বিসিএসে কোচিংয়ের শিখিয়ে দেওয়া প্রশ্নের উত্তর নয়, ভাইভার প্রশ্নও সৃজনশীল হচ্ছে
বিসিএস ভাইভাতে প্রচলিত যেসব প্রশ্ন করার প্রবণতা রয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। ভাইভাতে যেসব প্রশ্নের মাধ্যমে প্রকৃত মেধাবী খুঁজে বের করা যায়, সেই প্রশ্নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে পিএসসি। তবে ভাইভায় প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রবণতা কমে আসতে আরও সময় লাগবে বলে মনে করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।
পিএসসি জানিয়েছে, কোনো পরীক্ষক যদি ভাইভা প্রার্থীকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি কোনো ক্যাডারে প্রথম পছন্দ দিয়েছেন। প্রার্থী সেটি বলার পর পরীক্ষক সেই ক্যাডারের নানা কাজ নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন। প্রার্থী সেসব প্রশ্নের উত্তরও দেন। এসব শেখেন কোথা থেকে? সাধারণত এখন কোচিং সেন্টারগুলো কোন কোন প্রশ্ন হতে পারে, সেগুলোর ওপর প্রশিক্ষণ দেয় চাকরিপ্রার্থীদের। আর চাকরিপ্রার্থীরাও সেসব উত্তর মুখস্থ করে ভাইভা বোর্ডে গড়গড় করে বলে দেন। এতে ভাইভা প্রার্থীর মেধা প্রমাণ হয় না বলে মনে করে পিএসসি। তাই প্রশ্নের ধরনে পরিবর্তন আনতে কাজ করছে পিএসসি। এ জন্য পিএসসি সৃজনশীল প্রশ্নের ওপর গুরুত্ব দেবে। যেখানে প্রার্থীকে মাথা খাটিয়ে উত্তর দিতে হবে। কারও বাতলে দেওয়া উত্তর তিনি ভাইভা বোর্ডে বলে দিলেন আর ভালো নম্বর আশা করলেন, এমনটা হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষক যদি সৃজনশীল প্রশ্ন করেন, তাহলে সেটির তৈরি বা মুখস্থ উত্তর পরীক্ষার্থী বলতে পারবেন না। তাঁকেও মাথা খাটিয়ে উত্তর দিতে হবে। এতে উত্তরের গভীরতা বোঝা যাবে। এই সৃজনশীল প্রশ্ন হয়তো একদিনে প্রতিষ্ঠিত হবে না। কিন্তু এটির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। চাকরিপ্রার্থীকে বিভিন্ন ক্যাডারের দায়িত্ব-কর্তব্য কী এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু তিনি তো ওই পদে চাকরিই করেননি। তাহলে ওই বিষয়ে জানবেন কীভাবে। এটি দিয়ে মেধার যাচাই হয় না। চেয়ারম্যান আরও বলেন, অনেক বিষয়ে সংস্কার আনার ক্ষেত্রে পিএসসি কাজ করছে। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগবে। কিন্তু যখন প্রতিষ্ঠিত হবে, তার সুফল সবাই পাবেন।
চাকরিপ্রার্থীকে বিভিন্ন ক্যাডারের দায়িত্ব-কর্তব্য কী এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু তিনি তো ওই পদে চাকরিই করেননি। তাহলে ওই বিষয়ে জানবেন কীভাবে। এটি দিয়ে মেধার যাচাই হয় না।সোহরাব হোসাইন, পিএসসি চেয়ারম্যান
পিএসসি-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিসিএসের ভাইভায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন জেলার নাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, ধর্ম—এসব প্রশ্ন করতে পরীক্ষকদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কারণ, এসব প্রশ্নের কারণে পরীক্ষকদের চাকরিপ্রার্থী ভাইভা দিতে আসা প্রার্থীর প্রতি দুর্বলতা বা নেতিবাচক ধারণা হতে পারে। কোনো পরীক্ষকের নিজের বিশ্ববিদ্যালয় বা জেলার কোনো প্রার্থী পেলে তিনি বেশি ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে পারেন। তেমনি পরীক্ষক কোনো জেলার মানুষ যদি পছন্দ না করেন, আর ভাইভাপ্রার্থী যদি সেই জেলার হন, তাহলে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতে পারে। আর এই ইতিবাচক ও নেতিবাচক মনোভাব পরীক্ষার্থীর নম্বরে প্রভাব ফেলতে পারে। আবার দেশের নাম, মুদ্রার নাম বা কোন দেশের রাজধানী কী—এমন প্রশ্ন পরীক্ষকদের এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে পিএসসি। কারণ, এগুলো গৎবাঁধা প্রশ্ন। এগুলো মেধার নির্ণায়ক নয়।
ভাইভা বোর্ডে কোনো প্রার্থী প্রশ্নের উত্তর বলতে না পারলে তাঁকে হেয় করা, ধমক দেওয়া বা কী পড়াশোনা করেছেন বলে ভর্ৎসনা করা—এমন বিষয়ে আর করা হবে না বলে জানিয়েছে পিএসসি। পিএসসি মনে করে, প্রার্থীকে বোর্ডে হেয় করলে প্রার্থী ঘাবড়ে গিয়ে জানা উত্তর ভুল করতে পারেন। নার্ভাস হয়ে যেতে পারেন।
পিএসসি মনে করে, একজন পরীক্ষক অনেক বোর্ডে অনেক চাকরিপ্রার্থীর ভাইভা নেন। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীর কথা বোর্ডের সদস্যদের মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু একজন পরীক্ষার্থী যে ভাইভা বোর্ডে যাচ্ছেন, সেই স্মৃতি সহজে ভোলেন না। পরীক্ষার্থীর ভাইভা বোর্ডের স্মৃতি যাতে খারাপ না হয়, অর্থাৎ তিনি বোর্ড থেকে যাতে কষ্ট না পান বা হেয় না হন, সে জন্য পিএসসি সজাগ থাকবে। প্রশ্নের উত্তর বলতে না পারার কারণে তিরস্কারও করা যাবে না। এ ছাড়া প্রার্থীকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করা যাবে না। তাঁকে ‘আপনি’ করে বলতে হবে।
পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পিএসসিকে এমন একটি স্থানে নিয়ে যেতে চাই, যাতে এ নিয়ে মানুষের প্রশ্ন না থাকে। এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে আমরা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এ জন্য সব পরীক্ষায় আমরা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। এরই অংশ হিসেবে ভাইভা বোর্ডেও পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। বোর্ডে প্রার্থীর রোল নম্বর ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। যাতে তাঁর ব্যক্তিগত কোনো তথ্য কোনো পরীক্ষককে প্রভাবিত করতে না পারে। তবে এসব পরিবর্তন একদিনে আসবে না। সময় লাগবে। আমরা সেটি নিয়ে কাজ করছি।’