'খরচই উঠছে না, মুখে হাসি থাকবে কোথা থেকে?'
কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকার বোরো ধান ও চাল ক্রয় শুরু করলেও বাজারে এর প্রভাব তেমন পড়েনি। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বাজারে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি হচ্ছে। এতে হতাশ প্রান্তিক কৃষকেরা।
কৃষকদের অভিযোগ, প্রতিবছরই কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য খাদ্য বিভাগের মাধ্যমে ধান-চাল ক্রয় করে সরকার। তবে সরকারের এই ভর্তুকির অর্থ সাধারণ কৃষকদের পকেটে না গিয়ে মধ্যস্বত্বভোগী, ধান-চাল ব্যবসায়ী ও মিলমালিকদের পকেটে চলে যায়। এবারও তা–ই ঘটছে। কৃষকেরা বলছেন, সরকার ২৬ টাকা কেজি দরে ১ হাজার ৪০ টাকায় প্রতি মণ ধান ক্রয় করছে। আর ৩৬ টাকা দরে ১ হাজার ৪৪০ টাকায় প্রতি মণ চাল ক্রয় করছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে ৪০ কেজির জায়গায় ৪৫ কেজি ধরে প্রতি মণ ধান ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করছেন কৃষকেরা।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার ধামুরা গ্রামের যুবক সিরাজুল ইসলাম (৩৬) এবার ৮ একর জমিতে বোরোর আবাদ করেছেন। ফলনও ভালো পেয়েছেন। তবে ভালো ফলন হাসি ফোটাতে পারেনি সিরাজুলের মুখে। তিনি বলেন, ‘বাম্পার ফলন হলেও বাজারে ধানের মূল্য কম। ৮ একর জমিতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে বোরো আবাদ করেছি। কিন্তু ধানের যে দাম, তাতে উৎপাদন খরচ ওঠে। লাভ ঘরে তোলা যাবে না। ধান কাটাতে মজুরি দিতে হয়েছে ৩৪ হাজার টাকা। মুখে হাসি আসবে কোথা থেকে?’
সিরাজুলের মতো আরও অনেক কৃষক আছেন, যাঁরা ধান আবাদ করে বিপাকে পড়েছেন। লাভ তো দূরে থাক, আসলও ঘরে তুলতে পারছেন না। উজিরপুর, গৌরনদীর কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এমন হতাশার কথা শোনা গেল।
গৌরনদীর বার্থী গ্রামের মাসুদ সরদার (৪৬) এবার এক একরে বোরো আবাদ করেছেন। তিনি বললেন, ‘জমি চাষ, সার, বীজ, কীটনাশক, শ্রমিক, সেচ, মাড়াইসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রতি মণ ধান ফলাতে আমাদের ৮৭৫ টাকা ৭৬ পয়সা খরচ হয়েছে। কিন্তু বাজারে প্রতি মণ ধানের দাম পাচ্ছি ৪৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। এই ক্ষতি কীভাবে পোষাব আমরা? বাজার থেকে চাল কিনতে গেলে ৫০-৬০ টাকা কেজিতে কিনতে হয়। তবু বছরের খোরাকিটা এই দিয়ে রাখি। কিন্তু এই সব করে আমাদের কোমর ভেঙে যাচ্ছে।’
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে, চলতি বছর বরিশালের ছয় জেলায় ১ লাখ ৪৬ হাজার ৮১১ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৭৬৩ মেট্রিক টন ধান। এরই মধ্যে এই ধানের বেশির ভাগ কাটা হয়ে গেছে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে মনে করছেন কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক তৌফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে এবং ফলনও ভালো হয়েছে। সরকার প্রতি মণ ধানের মূল্য ১ হাজার ৪০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব খাদ্য বিভাগের।
বরিশাল বিভাগীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্র জানায়, গত ২৮ মার্চ খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় বোরো ধান ও চাল কেনার সিদ্ধান্ত হয়। ফড়িয়ারা লাভবান না হয়, সে জন্য কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার সিদ্ধান্ত হয়। গত ২৫ এপ্রিল থেকে এই ক্রয় শুরু হয় এবং তা পুরো আগস্ট মাস পর্যন্ত চলবে। এই কার্যক্রমের আওতায় বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় ১৬ হাজার ৩০ মেট্রিক টন চাল ও ৫ হাজার ১৯ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করা হবে।
আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্র জানায়, গতকাল পর্যন্ত বিভাগের ছয় জেলায় ১০০ মিলমালিকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। তাঁরা চাল সরবরাহ করবেন। গতকাল পর্যন্ত এই বিভাগে ৬২৭ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে কোনো ধান সংগ্রহ করা যায়নি।
ধান ক্রয়ের বিষয়ে প্রচার চালানো হয় কি না জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগীয় আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক রেজা মো. মোহসিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধান-চাল ক্রয়ের আগে মাইকিং, সাইনবোর্ড ঝোলানো, প্রচার চালানোর নিয়ম আছে। সেটা ঠিকভাবে করা হয় না বলে কৃষক জানতে পারে না—এমন অভিযোগ আছে তবে। সেটা সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা ক্রয় কমিটি দেখভাল করে।’