১৭৪৭ সালে সাড়ে ২৪ লাখ আর্কট মুদ্রার বস্ত্র রপ্তানি
ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা এখনো তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য বিশ্বখ্যাত। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশ হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এ দেশের বস্ত্র খাতের ইতিহাস কয়েক শ বছরের পুরোনো। দিল্লির শাহি দরবারে অভিজাত পোশাক সরবরাহ করা হতো এই ঢাকা থেকে। ভারতের পাশাপাশি ইউরোপের রাজপরিবার ও অভিজাত পরিবারেও যেত ঢাকাই পোশাক।
দিল্লির দরবারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিল ঢাকাই মসলিনের। সবচেয়ে অনুপম ও ব্যয়বহুল মসলিন ‘মলমল খাস’ যেত দিল্লির শাহি দরবারে। এই মসলিন শুধু দিল্লির সম্রাটের জন্য বিশেষভাবে তৈরি হতো। বাংলার নবাবেরা আনুগত্য ও শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে মলমল খাস উপহার হিসেবে দিল্লির সম্রাটের কাছে পাঠাতেন। যুগে যুগে এটিই রেওয়াজ ছিল। মলমল খাসের পাশাপাশি সিল্ক কাপড়, সাধারণ কাপড় ও সেরবন্ধও পাঠানো হতো।
এভাবেই যুগের পর যুগ ঢাকার মসলিন ও নানা ধরনের কাপড় রাজপরিবার, ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের কাছে লোভনীয় ছিল। ঢাকার বস্ত্র খাতের ব্যবসা শুধু এই মোগল সাম্রাজ্য নয়, ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
ঢাকা চেম্বার প্রকাশিত ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস বইয়ে ১৭৪৭ সালে ঢাকা থেকে বস্ত্র রপ্তানির একটি চিত্র পাওয়া যায়। ওই বছর ঢাকা থেকে সাড়ে ২৪ লাখ সমপরিমাণ আর্কট মুদ্রার মসলিনসহ অন্যান্য বস্ত্র রপ্তানি হয়েছিল। তখন আর্কট মুদ্রায় রপ্তানি হতো। রপ্তানির এই পরিসংখ্যান ১৮০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা রেসিডেন্ট জেমস টেলরের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল।
ঢাকাই বস্ত্রের অভিজাত শ্রেণির কাছেই বেশি যেত। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৭৪৭ সালে দিল্লির রাজপরিবারের জন্য ১ লাখ সমপরিমাণ আর্কট মুদ্রার মসলিন কাপড় গেছে। এ ছাড়া মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবার নিয়ে গেছে ৩ লাখ আর্কট মুদ্রার কাপড়। মুর্শিদাবাদের জগৎ শেঠ পরিবার নিয়েছিল দেড় লাখ আর্কট মুদ্রার বস্ত্র। তুর্কি, মোগল, পাঠান, আর্মেনীয় ও হিন্দু বণিকেরা ওই বছর ঢাকা থেকে আমদানি করেছেন প্রায় ১৩ লাখ আর্কট মুদ্রার মসলিনসহ অন্যান্য বস্ত্র। এ ছাড়া ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজ বণিকেরা সাড়ে ৯ লাখ আর্কট মুদ্রার বস্ত্র কিনে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেছিলেন।
সুলতানি ও মোগল আমলে ব্যাপক চাহিদা ছিল ঢাকাই মসলিনের। মসলিনের মূল ক্রেতা ছিলেন এশিয়া ও ইউরোপের রাজপরিবার ও অভিজাত শ্রেণি। মসলিন ছাড়া এসব রাজপরিবারের পোশাক–পরিচ্ছদ অসম্পূর্ণ থাকত।
দিল্লির শাহি দরবার, ঢাকার মোগল অমাত্য এবং উত্তর ভারতের রাজপরিবারের মসলিনের প্রায় শতভাগ চাহিদা পূরণ করতেন ঢাকা তাঁতিরা। বাংলার সুবাদারেরা প্রতিবছর উপঢৌকন হিসেবে উৎকৃষ্ট মানের মসলিন পাঠাতেন। রাজকীয় তত্ত্বাবধানে এবং রাজকর্মচারীদের উপস্থিতিতে বাংলার মসলিন কারখানায় ওই সব মসলিন বিশেষভাবে তৈরি হতো। একসময় ইউরোপগামী প্রতিটি জাহাজে ‘মসলিন’ ছিল একটি অত্যাবশ্যকীয় কার্গো।
১৭৮৪ সালের প্যারিস শান্তিচুক্তির পর আমেরিকা ও ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা ঢাকা তথা বাংলার বস্ত্রশিল্পে আসতে শুরু করেন। ফলে বস্ত্রশিল্পের ব্যবসা বাড়তে থাকে। এ সময় এই অঞ্চলের বহু লোক কৃষিকাজ ছেড়ে তাঁতশিল্পের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সরকারি হিসাব বলছে, ১৭৮৬ সালে প্রায় ৬০ লাখ তন্তুবায় ওই সব বিদেশি কোম্পানির তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। তখনকার আমলে এই তাঁতশিল্পে ৬০ লাখ লোকের সংশ্লিষ্টতা অনেকটা অবিশ্বাস্যই মনে হয়। কারণ, ওই সময়ে বাংলার অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী বস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ছিল। তবে এর ফলে উত্তর ভারতীয় রাজপরিবারের সঙ্গে ব্যবসা করার সুযোগ সীমিত হলেও ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়েছিল বিশ্বজুড়েই। লন্ডন, হামবুর্গ, কোপেনহেগেন, লিসবন, আমেরিকা, ম্যানিলা, মাসকট, চীন, মালয়েশিয়া—এসব দেশের বাংলার বস্ত্র খাতের বাজার তৈরি হয়।