১৭ দেশে বাহারের সফটওয়্যার
‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে ভেবেছি চাকরি করব না, নিজেই একটা কিছু করব।’ কিছু একটা করতেই ২০০৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার কৌশল থেকে স্নাতক করার পরপরই একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন হাবীব উল্লাহ বাহার। নাম দেওয়া হয় প্রগম্যাটিক ডেভেলপার্স নেটওয়ার্ক। এটা ছিল মূলত দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফরমায়েশি কাজ করা। কখনো ওয়েবসাইট বানানো বা ওয়েবসাইটের সক্রিয়তা বাড়ানো, কখনো অফিস ব্যবস্থাপনার জন্য সফটওয়্যার বানিয়ে দেওয়া। চার বছরের মধ্যে ১৯ জনের একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো সেটি।
হাবীব উল্লাহ বাহার বললেন, ‘কিন্তু আমি ফরমায়েশি কাজের পরিবর্তে নিজস্ব প্রোডাক্ট নিয়ে ভেবেছি। ভাবতাম আমার নিজের একটা প্রোডাক্ট হবে, যা ব্যবহার হবে দেশ-বিদেশে। কিন্তু সিএসই গ্র্যাজুয়েট হিসেবে টেকনোলজি যতটা বুঝি, ব্যবসা ঠিক ততটা বুঝি না।’ ঢাকায় নিজের অফিসে বসে বলছিলেন বাহার। ‘তাই খোঁজ করছিলাম এমন একজনের, যিনি কিনা ব্যবসার অংশটা বুঝবেন।’
২০১৪ সালে একটি স্টার্টআপ–সংক্রান্ত প্রতিযোগিতায় মেন্টর হিসেবে কাজ করার সুযোগ হলো বাহারের। সেখানেই পরিচয় হলো জার্মান নাগরিক আলেক্সিজ রওলিনসনের সঙ্গে। আলেক্সিও খুঁজছিলেন এমন একজন, যিনি কিনা তাঁর ব্যবসার আইডিয়ার কারিগরি দিকটা দেখতে পারবেন। ‘আমি বুজলাম, যে স্বপ্ন আমি কারিগরিভাবে দেখেছি, সেটির ব্যবসায়িক স্বপ্নটা দেখেছেন আলেক্সি।’ ব্যস, পরের বছর ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হলো ফিল্ড ইনফরমেশন সলিউশন। কোম্পানি নিবন্ধিত হলো জার্মানি এবং বাংলাদেশে। আলেক্সি আর বাহার হলেন সহপ্রতিষ্ঠাতা।
‘আমরা কাজ করছি মূলত একটি জায়গায়। সেটি হলো সফটওয়্যারের লাস্ট মাইল সলিউশন।’ অর্থাৎ, একেবারে শেষ মাথায়, অর্থাৎ চূড়ান্ত বেনিফিশিয়ারি বা উপকারভোগীর কাজে সফটওয়্যারকে নিয়ে যাওয়া। যেমন মাইক্রোফিন্যান্স। এ ক্ষেত্রে মাইক্রোফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানের অফিসেই মূলত সফটওয়্যারটি কাজ করে। এর কর্মীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে এ–সংক্রান্ত তথ্য জোগাড় করেন, সেটি হয় অফিসে এসে মূল সফটওয়্যারে এন্ট্রি দেন অথবা নিজেরা একটি স্প্রেডশিট তৈরি করে প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তি শাখায় পাঠিয়ে দেন। ‘এতে অনেক সময় একেবারে হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায় না। এ সমস্যা সমাধানে আমাদের সফটওয়্যারটি কাজ করে। এতে কর্মী ঋণগ্রহীতার সামনেই এন্ট্রির কাজটা করেন এবং খুবই কম ক্ষমতাসম্পন্ন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সরাসরি সার্ভারে পাঠিয়ে দিতে পারেন। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে সব তথ্য হালনাগাদ হতে পারে।’ বাহারের কথা শুনে বোঝা গেল, এটি অনেকটা সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ইআরপি এসএপি বা সেলসফোর্সের মতো। ‘তবে আমাদেরটার বাহাদুরি হলো, আমরা অন্য সফটওয়্যারের সঙ্গেও কাজ করতে পারি।’ বাহার জানালেন, ব্র্যাকের কোর সফটওয়্যারের সঙ্গে তাঁদের সফটওয়্যার ফিল্ডবাজ ব্যবহৃত হচ্ছে ব্র্যাকের রুয়ান্ডা ও তানজানিয়ায়।
তবে কেবল মাইক্রোফিন্যান্স নয়, যাঁরা খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করেন, তাঁদের জন্য এটি একটি সহায়ক ব্যবস্থা। বিশেষ করে এসএপি বা সেলসফোর্সের মতো ডিলার পর্যন্ত ব্যবস্থাপনায় খুশি না হয়ে সেটিকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা যায় ফিল্ডবাজের মাধ্যমে। ফলে মূল প্রতিষ্ঠান একেবারে তার বিতরণের সর্বশেষ এনটিটি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তথ্য জানতে পারে। এ কারণে ইদানীং এই সফটওয়্যারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
বর্তমানে আফ্রিকার কেনিয়া, উগান্ডা, হন্ডুরাস, ব্রাজিল, মিয়ানমার, ইথিওপিয়া, কলম্বিয়া, বাংলাদেশসহ মোট ১৭টি দেশে ফিল্ডবাজ সফটওয়্যারটি ব্যবহৃত হচ্ছে। জার্মানির বিখ্যাত নওম্যান কাফিগ্রুপ কবেল ২০১৯ সালে এর মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কৃষককে এর আওতায় এনেছে। ফিল্ডবাজ প্ল্যাটফর্মে ২০১৯ সালে এক কোটি ডলারের বেশি লেনদেন হয়েছে। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় সফটওয়্যারের নতুন বাজার তৈরি হচ্ছে বলে সেখানেই বাজার সম্প্রসারণ করছে ফিল্ডবাজ। ২০২০ সালের আগস্টে জার্মানি ও ঢাকার পর তাদের তৃতীয় অফিস চালু হবে আফ্রিকার সেনেগালে।
এই সফটওয়্যারে সুফল যেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও নিতে পারেন, সে জন্য ফিল্ডবাজের একটি সাস (সফটওয়্যার অ্যাজ আ সার্ভিস) মডেলও রয়েছে। এত ব্যবহারকারী প্রতি মাসে মাত্র ৪০০ টাকা দিয়ে যেকোনো উদ্যোক্তা ফিল্ডবাজের ১৩টি মডিউলের দরকারিটি ব্যবহার করতে পারেন।
চিকিৎসক স্ত্রী নাজিফা নাওয়াল হুদাকে নিয়ে বনশ্রীতে থাকেন হাবীব উল্লাহ বাহার। পাহাড়ে চড়তে বা ম্যারাথন দৌড়াতে প্রায়ই ঘর থেকে বের হয়ে পড়েন। ব্যবসা প্রসারে উদ্যোক্তাদের আরও সহায়তা দেওয়ার জন্য ম্যারাথনের মতো দীর্ঘ সময় নিয়ে কাজ করতে চান এই তরুণ উদ্যোক্তা।