সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে এবার বড় পরিবর্তন
বেসরকারি খাতের সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন হয়েছে। এ কারণে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) হঠাৎ পদত্যাগ করতে হয়েছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে এক সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়।
তবে ওই সভায় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান রেজাউল হক, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আনিসুল হক, এমডি শহীদ হোসেনকে দেখা যায়নি। একই প্রক্রিয়ায় গত জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংকেও পরিবর্তন আসে। এবারও এ পরিবর্তনের সঙ্গে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের নাম এসেছে।
নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফ। নতুন এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত এমডি কাজী ওসমান আলীকে। এ ছাড়া নির্বাহী কমিটির নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদ। তিনি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের জামাতা। সভা চলাকালে সাইফুল আলমকেও হোটেল ওয়েস্টিনে দেখা গেছে।
ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান চট্টগ্রামেই বসবাস করেন। এসআইবিএল সূত্রে জানা গেছে, দুই দিন আগে তাঁকে ঢাকায় আসতে বলা হয়। এরপরই এসব পরিবর্তন আনা হয়।
যোগাযোগ করা হলে আনোয়ারুল আজিম আরিফ গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকটির সভায় নতুন চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ও এমডি নিয়োগ হয়েছে।’ এর চেয়ে বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।
এর আগে ১৯ অক্টোবর প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এই ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনাবেচা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘গভর্নর ফজলে কবিরকে বলেছি তাঁদের আচ্ছা করে শাস্তি দিতে।’
বিষয়টি নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘পর্ষদে পরিবর্তনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকই ভালো বলতে পারবে। আমরা পরবর্তী সময়ে বিষয়টি দেখব।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে বলেন, ‘বেসরকারি খাতের ব্যাংকে মালিকানায় পরিবর্তন আসতেই পারে। তবে বর্তমানে যা হচ্ছে, তাতে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে যেন ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থার ঘাটতি না হয়। এমনটি হলে দায়দায়িত্ব নতুন মালিকদের ওপরই বর্তাবে।’
>পরিচালনা পর্ষদের সভা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নয়, বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় হয়েছে ওয়েস্টিন হোটেলে
ইব্রাহিম খালেদ বলেন, যাঁরা এভাবে ব্যাংক অধিগ্রহণ করছেন, তাঁরা ইসলামি ব্যাংকগুলোর প্রতি বেশি আগ্রহী। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধোঁয়াশা আছে, বিষয়গুলো পরিষ্কার করার দায়িত্ব তাঁদেরই।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, গতকাল সোমবার ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে পরিচালনা পর্ষদের পূর্বনির্ধারিত সভা ছিল। তবে সকাল থেকেই ব্যাংকটির কয়েকজন পরিচালককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পর্ষদ সভার কথা বলে তাঁরা সকালে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। পরে তাঁদের কয়েকজনকে ওয়েস্টিন হোটেলে দেখা যায়। দুপুরের আগ থেকেই শুরু হওয়া সভায় জানানো হয়, আগের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, এমডি পদত্যাগ করেছেন। তবে ওই সভায় এই তিনজন উপস্থিত ছিলেন না। গতকাল রাত পর্যন্ত ফোনে চেষ্টা করেও তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যায়নি।
সভায় হাসান আবাসন লিমিটেডের পক্ষে নতুন পরিচালক মনোনীত করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফকে। পরে তাঁকেই চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ওই সভায়ই ইউনিটেক্স স্টিল ও সিমেন্টের পক্ষে নতুন পরিচালক হিসেবে বেলাল আহমেদকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে তাঁকেই ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। সভায় নতুন এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় কাজী ওসমান আলীকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের পরই এ নিয়োগ কার্যকর হবে বলে জানানো হয়।
গতকাল বেলা দুইটার দিকে ওয়েস্টিন হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে চতুর্থ তলায় পর্ষদের সভা চলছে। সভায় উপস্থিত আছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম। তিনটার পর তাঁরা এই তলাতেই দুপুরের খাবার খান। এ সময় দুজন সাংবাদিক বিষয়টি জানতে এগিয়ে গেলে তাঁদের সরিয়ে দেন বিশেষ নিরাপত্তা দলের সদস্যরা। এরপর প্রথমে সাইফুল আলম হোটেল থেকে বের হয়ে যান। পরে অন্যরাও হোটেল থেকে বেরিয়ে যান।
এ সময় কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। সভায় কী সিদ্ধান্ত হয়েছে তা জানতে ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো বক্তব৵ পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত আগস্ট-অক্টোবর মাসে ব্যাংকটির প্রায় ৪০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় এস আলম গ্রুপ। নিজের নাম ছাড়াও কয়েকটি নতুন প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার কেনা হয়। এরপর গতকালের সভায় ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে। নতুন নতুন কোম্পানির নামে কেনা এসব প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয় রাজধানীর দিলকুশার ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ক্যাপিটেল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট অফিসের। এই প্রতিষ্ঠানটি এস আলম গ্রপের মালিকানাধীন। এ ছাড়া চট্টগ্রামের আছদগঞ্জের এস আলম ভবনের ঠিকানা ব্যবহার করেও নতুন কোম্পানির শেয়ার কেনা হয়।
সূত্রমতে, গত বছরের জুলাই থেকে ব্যাংকটির শেয়ার কেনা শুরু করেছিল ঢাকার ইউনাইটেড গ্রুপ। আগস্ট পর্যন্ত ইউনাইটেড গ্রুপ-সংশ্লিষ্টরা শেয়ারবাজারের মাধ্যমে ব্যাংকটির প্রায় ৩১ শতাংশ শেয়ার কেনে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগও করে। কিন্তু ব্যাংকটির পর্ষদে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তারা এসব শেয়ার চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের কাছে বিক্রি করে।
১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করা এসআইবিএলের শাখা ১৩৫টি। ব্যাংকটিতে ১২ হাজার কোটি টাকা আমানত রয়েছে। ২০০০ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর এখন এর শেয়ারধারীর সংখ্যা প্রায় ৩৯ হাজার। তবে গতকালের শেয়ারবাজারে এর দামের ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি।
প্রসঙ্গত, গত বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কেনে এস আলম গ্রুপ। ওই সময় ব্যাংকটির ২৫ শতাংশ শেয়ার কেনা হয়। এরপরই জানুয়ারিতে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে। ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে বড় গ্রাহকও চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। গ্রুপটির মালিকানায় রয়েছে খাদ্য, সিমেন্ট, স্টিল, বিদ্যুৎ, পরিবহন, শিপিং, কৃষি ও গণমাধ্যমের কমপক্ষে ৩০ প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, আল-আরাফাহ্ ইসলামী, ইউনিয়ন, এনআরবি গ্লোবাল, বাংলাদেশ কমার্স, রিলায়েন্স ফাইন্যান্সেও মালিকানা রয়েছে গ্রুপটির। দেশের ইসলামি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক্সিম ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ছাড়া সব কটিই এখন চট্টগ্রামভিত্তিক এই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে।