সুখস্থান নামের দেশের জিডিপির গল্প
জিডিপির আবিস্কার
জিডিপির আবিষ্কার হয়েছিল এক মহামন্দার সময়ে। ১৯৩০-এর মহামন্দায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি তখন হিমশিম খাচ্ছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নানা পরিকল্পনা নিয়ে ভাবছে সরকার। অথচ অর্থনীতির ঠিকঠাক চিত্রটাই জানা নেই। তথ্য-উপাত্ত সব অসম্পূর্ণ। ফলে পরিকল্পনাও করতে পারছিলেন না সে সময়ের প্রেসিডেন্ট হারবার্ট হুবার।
অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেতসের জন্ম ও বেড়ে ওঠা রুশ সাম্রাজ্যে। ১৯২২ সালে পরিবারসহ চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতি বের করার দায়িত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়। ১৯৩৭ সালে তিনি কংগ্রেসের কাছে ‘ন্যাশনাল ইনকাম ১৯২৯-৩৫’ নামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তখন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। সেই থেকে শুরু। সাইমন কুজনেতস এই মৌলিক কাজের জন্য অর্থনীতিতে নোবেল পান ১৯৭১ সালে।
জাতীয় আয় পরিমাপ পদ্ধতির বড় একটি পরিবর্তন আসে আরেক সংকটের সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য আরও কিছু তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯৪২ সালে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়। আরেক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ওয়াসেলি লিওনতিফ জাতীয় আয় পরিমাপ পদ্ধতিতে উপকরণ-উৎপাদন বা ইনপুট-আউটপুটকে অন্তর্ভুক্ত করেন। ৬০ ও ৭০ দশকে মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করা শুরু হয়। এরপরও ক্রমান্বয়ে জাতীয় আয় পরিমাপ পদ্ধতিকে হালনাগাদ করা হয়েছে।
ভালো থাকা বনাম জিডিপি
এক গভীর সংকটের সময়ে জিডিপির আবিষ্কার হলেও ৬০-এর দশকেই অর্থনীতিবিদেরা মেনে নিয়েছিলেন যে কেবল জিডিপি একটি দেশের অগ্রগতির একমাত্র নির্ণায়ক নয়। মার্কিন অর্থনীতিবিদ মোসেস আবরামোভিতজ ১৯৫৯ সালে প্রথম এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এই প্রশ্ন থেকেই পরবর্তী সময়ে ভালো থাকা বা ‘ওয়েল বিইয়িং’ ধারণাটি জায়গা করে নেয়। এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাই রবার্ট কেনেডির ১৯৬৮ সালের ১৮ মার্চ ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসে দেওয়া এক বক্তৃতা একটি মাইলফলক হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘জিডিপি আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্য, স্কুলের শিক্ষার মান কিংবা খেলার আনন্দকে গোনায় ধরে না। আবার জিডিপি আমাদের কবিতার সৌন্দর্য কিংবা বিয়েব্যবস্থার শক্তির দিক, বুদ্ধিদীপ্ত গণবিতর্ক কিংবা সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মনিষ্ঠাকেও গোনায় ধরতে জানে না। এমনকি আমাদের বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ, সাহস, প্রজ্ঞা, শিখতে পারার ক্ষমতা, আমাদের আবেগ, আমাদের দেশভক্তি-কোনো কিছুকেই গোনায় ধরে না এই জিডিপি। আসলে জিডিপি সবকিছুই মাপে, কেবল যা যা আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে, সেসব ছাড়া।’
১৯৭২ সালে ভুটানের রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক ঘোষণা দেন তাঁর লক্ষ্য জিডিপির প্রবৃদ্ধি না, বরং জিএনএইচ (গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস)।
জিডিপির রাজনীতি
তবে জিডিপি গুরুত্ব হারিয়েছে, তা বলা যাবে না। বরং এখন জিডিপির রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ উঠছে। চীন ও ভারত বহু বছর ধরে বিশ্বের সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির দেশ। অভিযোগ আছে ভারত ও চীন নিয়েও।
লি কেচিয়াং চীনের প্রধানমন্ত্রী। ২০১৪ সালে তাঁর কিছু মন্তব্য ফাঁস করে দিয়েছিল উইকিলিকস। ২০০৭ সালে যখন একজন প্রাদেশিক নেতা, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘জিডিপির পরিসংখ্যান মনুষ্যসৃষ্ট।’ এ কারণে জিডিপি সংখ্যার পরিবর্তে লি তিনটি সূচককে নির্ভরযোগ্য বলেছিলেন। যেমন, বিদ্যুতের ব্যবহার, রেলওয়ের পণ্য পরিবহনের পরিমাণ এবং ব্যাংকঋণ। তিনি বলেছিলেন, অর্থনীতির গতি বুঝতে এই তিন পরিসংখ্যানকেই তিনি তুলনামূলক নির্ভুল মনে করেন। তাঁর ভাষায়, ‘অন্যান্য সব পরিসংখ্যান, বিশেষত জিডিপির পরিসংখ্যান কেবল বলার জন্য।’ সেই থেকে একে বলা হয়, ‘লি কেচিয়াং সূচক’।
বিপর্যস্ত অর্থনীতির চেহারা এখন দেশের প্রতিটি মানুষের চোখের সামনে। আয় কমছে বাড়ছে খরচ। অথচ সরকারি হিসেবে মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কৌতুক করে বলা হচ্ছে, মাথাপিছু আয়ের অর্থ মাথার পেছনে থাকা আয়, তাই আয় বৃদ্ধি কেউ দেখতে পারছে না।
আবার ভারতের একসময়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ওয়াই ভানুগোপাল রেড্ডি বলেছিলেন, ‘সাধারণত ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত থাকে। কিন্তু ভারতে অতীতটাই অনিশ্চিত বেশি।’ এর কারণ দেশটিতে বারবারই জিডিপির হিসাব সংশোধন করা হয়েছে। যেমন, ২০১৮ সালে মোদি সরকারের গঠন করা এক কমিটি জিডিপির হিসাব সংশোধন করে বলেছে, তাদের সময়েই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বেশি, কংগ্রেসের সময় কম। আগের হিসাবে যা ছিল উল্টো। এ ঘটনা নিয়ে মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর শিরোনাম ছিল ‘মোদির অধীনে ভারত বেশি ভালো করেছে, যদি আপনি জিডিপি বিশ্বাস করেন।’ অর্থনীতিবিদ ও বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ রুচির শর্মা লিখলেন, ভারতের জিডিপি এমনকি ‘বেসিক স্মেল টেস্ট’ও পাস করতে পারবে না।
প্রয়োজন নির্ভুল তথ্য
বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াচ্ছিল। প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। একই সঙ্গে পরিসংখ্যানের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কোভিড-১৯-এর সময়েই গবেষকেরা বলছেন, জিডিপির হিসাব রাজনৈতিক পরিসংখ্যানে পরিণত হয়েছে। বিপর্যস্ত অর্থনীতির চেহারা এখন দেশের প্রতিটি মানুষের চোখের সামনে। আয় কমেছে, বাড়ছে খরচ। অথচ সরকারি হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কৌতুক করে বলা হচ্ছে, মাথাপিছু আয়ের অর্থ মাথার পেছনে থাকা আয়, তাই আয় বৃদ্ধি কেউ দেখতে পারছে না।
এটা অনেকটা মহাকাশ উপগ্রহ থেকে পুরো মহাদেশ দেখার মতো, জিডিপিও এমনি করে পুরো দেশের অর্থনীতির একটি সামগ্রিক চেহারা দেখায়।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলশন তাঁর ইকোনমিকস বইয়ে জিডিপি নিয়ে বলেছেন, ‘এটা অনেকটা মহাকাশ উপগ্রহ থেকে পুরো মহাদেশ দেখার মতো, জিডিপিও এমনি করে পুরো দেশের অর্থনীতির একটি সামগ্রিক চেহারা দেখায়। এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট, কংগ্রেস ও ফেডারেল রিজার্ভ বুঝতে পারে অর্থনীতি সংকুচিত হচ্ছে না প্রসারিত হচ্ছে, অর্থনীতির প্রণোদনা দরকার নাকি রাশ টানতে হবে, অর্থনীতি কি মন্দায় নাকি মূল্যস্ফীতির হুমকির মধ্যে।’
মার্কিন বাণিজ্য বিভাগ জিডিপির ৬০ বছর পূর্তিতে এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলেছিল, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির যে সাফল্য, তার ভিত্তি হচ্ছে একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে পারা। আর তা সম্ভব হয়েছে সময়োপযোগী, বিস্তৃত এবং নির্ভুল তথ্য পাওয়ার কারণে।’
কোভিড-১৯-এর কারণে অর্থনীতিতে যে মন্দা দেখা দিয়েছে, তা থেকে পুনরুদ্ধারের জন্যও প্রয়োজন অর্থনীতির একটি নির্ভুল চিত্র। এ রকম একসময়ে অর্থনীতির একটি সঠিক চিত্র দেওয়া হলে মানুষের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ত। অথচ মানুষ এখন দেখছে জীবন চলছে না, আয় নেই, ব্যয় বাড়ছে, কিন্তু জিডিপিতে এর কোনো প্রতিফলন নেই।
সুখস্থান রাজ্যের গল্প
আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি বইয়ে আকবর আলি খান সুখস্থান নামের এক দেশের একটি গল্প লিখেছিলেন। সুখস্থান রাজ্যে ১০০ জন সুদর্শন যুবক বাস করেন। তাঁদের প্রত্যেকের আয় বছরে এক কোটি টাকা। তাঁদের প্রত্যেকের বাড়িতে একজন করে গৃহকর্মী আছেন। বছরে তাঁদের বেতন এক লাখ টাকা করে। এ দেশে মোট জাতীয় উৎপাদন ১০১ কোটি টাকা আর মাথাপিছু আয় ৫০ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
একদিন এই ১০০ যুবকই তাঁদের নিজ নিজ গৃহকর্মীকে বিয়ে করে ফেললেন। স্ত্রীরা এখন খুশি হয়ে নিজের সংসারে তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেন, স্বামীরা আগের চেয়ে বেশি সুখে থাকেন। সবার সুখ বেড়ে গেছে। অথচ রাজ্যের সংখ্যাতত্ত্ববিদেরা বলছেন, রাজ্যে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৫০ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৫০ লাখে নেমে গেছে। কারণ, বিয়ের আগে গৃহকর্মীরা বেতন পেতেন। স্ত্রী হওয়ার পর তাঁরা একই কাজ করেও বেতন পান না। স্ত্রীকে স্বামীর দেওয়া অর্থ জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্তও হয় না। কাজেই সুখস্থান রাজ্যে সবার সুখ বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও মোট জাতীয় উৎপাদন ও মাথাপিছু আয় কমে গেছে।
এক বছর পর রাজ্যের ১০০ দম্পতি তাঁদের বিবাহবার্ষিকীতে নিজেদের নতুন গাড়িতে চড়ে বেড়াতে গেলেন। ফেরার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় ১০ জন স্ত্রী মারা যান। ১০ জন স্বামী প্রত্যেকে একটি করে পায়ের আঙুল হারান। আরও ২০ জন হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে যান। এক বছর পর রাজ্যের সংখ্যাতত্ত্ববিদেরা জানালেন যে রাজ্যে মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে; কারণ, ১০ জন স্ত্রী মারা যাওয়ায় জনসংখ্যা কমেছে অথচ সব পুরুষ জীবিত থাকায় মোট জাতীয় উৎপাদন কমেনি; বরং বেড়েছে। কেননা, হাসপাতালে মৃতদের সৎকারকারীদের এবং গাড়ি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় বেড়েছে।
পরের বছর সেনাবাহিনী রাজ্যের ক্ষমতা দখল করে নিয়ে রাজ্যের সবাইকে অতিরিক্ত পণ্য উৎপাদনে বাধ্য করল। এতে রাজ্যে মাথাপিছু আয় ২০ শতাংশ বেড়ে গেল। যদিও রপ্তানি আয়সহ রাজ্যের মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশ নতুন ক্ষমতাসীন প্রধান ও তাঁর ৯ জন স্যাঙাত আত্মসাৎ করেন। এর ফলে রাজ্যের ৯০ শতাংশের আয় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়। তার মানে, গড় আয়ের ভিত্তিতে মানুষের সুখ বেড়েছে। কিন্তু ৯০ শতাংশ লোকের মাথাপিছু আয় ও সুখ কমে গেছে। শুধু ১০ ভাগ লোকের আয় বেড়েছে। এভাবে দেখা গেল, সুখস্থান রাজ্যে মানুষের সুখ যখন বাড়ছে, মাথাপিছু আয় তখন কমে যাচ্ছে; আর যখন দুঃখ বাড়ছে, তখন মাথাপিছু আয়ও বাড়ছে। তবে দোষ সুখস্থানের নয়, সমস্যা হলো জাতীয় আয় প্রাক্কলনের পদ্ধতিতেই।
আমাদের এখানে ব্যয় করতে পারলেই জিডিপি বৃদ্ধি। ধরেন, একটা প্রকল্প করতে লাগে ৫ কোটি টাকা। পারস্পরিক যোগসাজশে সেটা ৫০ কোটি টাকা বানিয়ে ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করলেও সমস্যা নেই। জিডিপি তাতে বাড়বে।
কোভিড-১৯ টেস্ট করাতে সরকার ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। যত বেশি মানুষ আক্রান্ত হবে, যত বেশি টেস্ট হবে, তাতেও বাড়বে জিডিপি। আবার সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয়বহুল চিকিৎসায় ঠেলে দিতে পারলেও বাড়বে জিডিপি। অতিরিক্ত ব্যয়ে নিম্নমানের রাস্তা বানালে জিডিপি বাড়বে, আবার সেই রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বহুসংখ্যক মানুষ বছরের পর বছর চিকিৎসা নিতে থাকলেও জিডিপি বেড়ে যাবে।
কোভিড-১৯-এর সময়ে ৫ শতাংশের বেশি জিডিপি অর্জন তো সুখস্থান নামের একটি দেশের পক্ষেই সম্ভব। এখন মনে হয় বাংলাদেশের এই সূচকেরও একটি নাম দেওয়ার সময় এসেছে।