কর দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে—দেশের এমন ৬৮ শতাংশ মানুষই কর দেন না। কর দেন মাত্র ৩২ শতাংশ সামর্থ্যবান ব্যক্তি। এমনকি সবচেয়ে বেশি আয়ের ২৫ শতাংশ ব্যক্তির মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই আগের বছর আয়কর দেননি। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক ধারণা জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় গত বৃহস্পতিবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্থায়ন: সম্পদ আহরণ ও দক্ষ ব্যবহারের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সংলাপে জরিপের ফল তুলে ধরা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। সম্মানিত অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে নির্ধারিত আলোচক ছিলেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আবাসিক প্রতিনিধি র্যাগনার গুডমুন্ডসন ও মেট্রো চেম্বারের সভাপতি নিহাদ কবির। এ ছাড়া বক্তব্য দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সংলাপে ‘বাংলাদেশ কি বিদেশি সহায়তা ছাড়া চলতে পারবে’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এবং ‘বাংলাদেশে ব্যক্তিশ্রেণির আয়করের সম্ভাবনা’ শীর্ষক আরেকটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
তৌফিকুল ইসলাম খানের নেতৃত্বাধীন দলের জরিপে অংশ নেওয়া ৭৫ শতাংশ ব্যক্তিই মনে করেন, দেশের করব্যবস্থা ধনী ব্যক্তিদের পক্ষে। কর দিচ্ছেন এমন ৬৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, করব্যবস্থায় দুর্নীতি রয়েছে, আর ৫০ শতাংশ মনে করেন করব্যবস্থা জটিল। তবে ৮৫ শতাংশ ব্যক্তি মনে করেন সেবার মান বাড়ালে মানুষ কর দিতে উৎসাহী হবেন।
>৬৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, করব্যবস্থায় দুর্নীতি রয়েছে, আর ৫০ শতাংশ মনে করেন করব্যবস্থা জটিল।
আয়কর বৃদ্ধির জন্য আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সহজে রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা করা, কর কার্যালয়কে দুর্নীতিমুক্ত করা এবং কর ফাঁকি দেওয়া ধনী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার সুপারিশ করেন তৌফিকুল ইসলাম খান।
ফাহমিদা খাতুনের প্রবন্ধে বলা হয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে উন্নয়ন বাজেটের ৯৫ শতাংশ ছিল বিদেশি সহায়তানির্ভর, বাকিটা দেশীয় সম্পদ। আবার বিদেশি অর্থের ৯৫ শতাংশই ছিল অনুদান, বাকি ৫ শতাংশ ঋণ। বর্তমানে উন্নয়ন বাজেটের সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ আসে বিদেশ থেকে, যার ৯৫ শতাংশই ঋণ। সুতরাং বৈদেশিক সম্পদের আর দরকার নেই—এমনটা চিন্তা করার কোনো অবকাশ নেই।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এনবিআরের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, শহর এলাকার ফ্ল্যাটবাড়ির ভাড়াটে ও বাড়ির মালিকদের আয়কর রিটার্ন জমার ওপর আগামী ছয় মাসের মধ্যে একটি জরিপ চালানো হবে। যাঁরা এখনো কর দেন না, চাপ না দিয়েই তাঁদের কর দিতে উৎসাহিত করা হবে।
উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশের ৩৫ লাখ করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএনধারী) থাকলেও ২০ লাখের বেশি লোক আয়কর রিটার্ন দেন না। দুটি কারণে মানুষ ভয় পায়। একটা হচ্ছে আয়কর আইনজীবী, অন্যটি হচ্ছে আয়কর সংগ্রহকারী। মানুষের ধারণা, একবার যদি আয়কর দাতা হিসেবে নাম লেখানো হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে হয়রানির শিকার হতে হবে।’
মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ করদাতা—এ তথ্য স্বীকার করে এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেন, ‘অথচ প্রতিবেশী দেশেও এই হার ১৮ শতাংশের মতো। তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে করদাতার সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১২ থেকে ১৩ শতাংশে উন্নীত করতে চাই।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘জিডিপির তুলনায় এক দশকে বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর সংগ্রহ বাড়েনি। দেশের অর্থনীতির আকার যতটা বাড়ছে, জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায়ের হার ততটা বাড়ছে না।’
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু সম্পদ আহরণ ঠিকমতো হচ্ছে না। আবার জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়লেও সাধারণ মানুষ এর সুফল পাচ্ছে না। সমাজে বরং বৈষম্য বাড়ছে।’ দেবপ্রিয় বলেন, সুশাসনের দিকে নজর দিতে হবে। আর মধ্যম আয়ের দেশে যেতে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়ন করতে ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশে রূপান্তর-প্রক্রিয়ায় বৈদেশিক সাহায্যের দরকার রয়েছে, তবে তা সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে।
মেট্রো চেম্বারের সভাপতি নিহাদ কবির অবশ্য বলেন, করের আওতা বাড়ছে, তবে আদায় এখনো সীমিত করদাতার ওপরই নির্ভরশীল।