সরকারি সংস্থাই চিনির দাম বাড়াতে চায়
বাজারে দাম আরও বাড়াতে আমদানি করা চিনির ওপর বাড়তি কর আরোপের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়টির অধীন সংস্থা বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) নিজেদের চিনি বিক্রি করতে পারছে না বলে মন্ত্রণালয় এ চিঠি দেয়।
চিনি শিল্প করপোরেশনকে সুরক্ষা দিতেই চিনির ওপর দুই দফা কর বাড়িয়েছে সরকার। এখন প্রতি কেজি চিনিতে করভার প্রায় ২২ টাকা। নতুন যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে কেজিতে আড়াই টাকার মতো কর বাড়বে। অথচ এই চিনি শিল্প করপোরেশনই সব সময় দাবি করে যে তারা বাজারে চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১৩ জানুয়ারি এনবিআরকে দেওয়া এক চিঠিতে চিনির ওপর কর কমানোর সুপারিশ করেছিল।
জানতে চাইলে বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠান পারে না। কিন্তু পারা উচিত। তিনি উল্লেখ করেন, চিনি শিল্প করপোরেশনের চিনিকল আছে ১৫টি। এর কয়েকটিতে চিনির পাশাপাশি অ্যালকোহল উৎপাদন করে লাভজনক করা দরকার। বাকিগুলোতে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন বা অন্য খাতে যৌথ বিনিয়োগ করা যায়।
বাজারে এখন প্রতি কেজি খোলা চিনি ৬৫ টাকার আশপাশে ও প্যাকেটজাত চিনি ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দেশে বছরে প্রায় ১৮ থেকে ২০ লাখ টন চিনি আমদানি হয়। আর চিনি শিল্প করপোরেশন উৎপাদন করে মাত্র ৬০ হাজার টনের মতো। তারা প্রতি কেজি খোলা চিনি ৬০ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে। বেসরকারি চিনিকলগুলোর মিলগেটে কেজিপ্রতি দর ৫৩ টাকার আশপাশে। এতে সরকারি চিনির চাহিদা কমে গেছে।
>নিজেদের চিনি বিক্রি করতে না পেরে চিনি শিল্প করপোরেশন আমদানিতে কর বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে, যা দাম বাড়াবে বাজারে।
এনবিআরকে দেওয়া চিঠিতে শিল্প মন্ত্রণালয় বলেছে, ৬ মে পর্যন্ত হিসাবে সরকারি চিনিকলে ৬২ হাজার টনের মতো চিনি মজুত আছে। বেসরকারি মিলগুলো কম দামে চিনি বিক্রি অব্যাহত রাখলে সরকারি মিল বন্ধের উপক্রম হবে। তাই শিল্প মন্ত্রণালয় অপরিশোধিত চিনির ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) ১৫ শতাংশ বহাল রেখে সুনির্দিষ্ট আমদানি শুল্ক ৩ হাজার টাকার বদলে ৪ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। একইভাবে পরিশোধিত চিনির ওপরও শুল্ক বাড়ানোর কথা বলেছে মন্ত্রণালয়।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে অপরিশোধিত চিনির টনপ্রতি আমদানি শুল্ক ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা করা হয়। আবার নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় ৩০ শতাংশ। তখন আমদানিকারকেরা জানিয়েছিলেন, চিনিতে মোট করভার বাড়বে ৫ টাকা।
এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চিনি শিল্প করপোরেশনকে সুরক্ষা দিতে চিনির ওপর উচ্চহারে কর বাড়ানো হয়। তখন পাইকারি বাজারে চিনির কেজি ৪০ টাকার নিচে নেমেছিল।
জানতে চাইলে চিনি পরিশোধনকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, করের পুরো চাপটাই ভোক্তার ওপর পড়বে। চিনি শিল্প করপোরেশন বছর বছর ধরে বিপুল লোকসান গুণছে। একদিকে জনগণের করের শত শত কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটিকে ভর্তুকি হিসেবে দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে উচ্চ দামে চিনি কিনতে হচ্ছে মানুষকে।
চিনি শিল্প করপোরেশন জানিয়েছে, তাদের ১০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর জানুয়ারি থেকে বেতন বকেয়া। আখচাষিদের পাওনা, বেতন ও অবসরসুবিধা, সরবরাহকারীদের পাওনা বাবদ এখন ৮৫০ কোটি টাকার মতো দরকার। সরকার কয়েক দিন আগে দেড় শ কোটি টাকার মতো দিয়েছে।
চিনিকলগুলোকে কী করা যায়, জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে একটা গভীর পর্যালোচনা দরকার। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনটা বন্ধ, কোনটার কার্যক্রম সীমিত করে আনা, কোনটা সরকারি মালিকানায় রেখে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দেওয়া যায় এবং কোনটা পুরোপুরি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া যায়। এ কথা আমরা অনেক বছর ধরে বলে আসছি।’
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, চিনি শিল্প করপোরেশনের অদক্ষতা ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার মাশুল বহন করতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। তাদের যথেষ্ট সুরক্ষা দেওয়া আছে। নতুন কর আরোপ হলে ভোক্তাদের ওপর চাপ আরও বাড়বে।