শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধে হাত পেতেছে বিজেএমসি

বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে খুলনার পাটকলশ্রমিকেরা গতকাল বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খুলনা-যশোর মহসড়ক ও রেলপথ  অবরোধ করেন। এ সময় দাবি আদায়ে খুলনার নতুন রাস্তা মোড়ে শ্রমিক-ছাত্র-জনতা-ঐক্যের ব্যানারে সমাবেশ হয়।  ছবি: সাদ্দাম হোসেন
বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে খুলনার পাটকলশ্রমিকেরা গতকাল বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খুলনা-যশোর মহসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। এ সময় দাবি আদায়ে খুলনার নতুন রাস্তা মোড়ে শ্রমিক-ছাত্র-জনতা-ঐক্যের ব্যানারে সমাবেশ হয়। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পরিশোধে আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ে হাত পেতেছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। সংস্থাটি এবার সব মিলিয়ে ৩৩৮ কোটি টাকা চেয়েছে। পুরো অর্থ পেলে জুন পর্যন্ত বেতন-ভাতা দিতে পারবে বিজেএমসি।

অবশ্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাটকল শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পরিশোধের জন্য ঈদের আগে বিজেএমসিকে ১০০ কোটি টাকা দেওয়া হতে পারে। সেটি হলে বকেয়া বেতন-ভাতার পুরোটা দেওয়া সম্ভব হবে না। অর্থাৎ পাটকল শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়ে সমস্যা রয়েই যাবে।

অর্থের অভাবে পাটকল শ্রমিক ও কর্মচারীদের ৯ থেকে ১২ সপ্তাহের বেতন-ভাতা বকেয়া পড়েছে। বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে ৫ মে থেকে উৎপাদন বন্ধ রেখে আন্দোলন করে আসছেন খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকেরা। পরে পাটকল শ্রমিক লীগ এবং সিবিএ ও সিবিএ–বহির্ভূত (নন-সিবিএ) নেতাদের আহ্বানে ১৩ মে থেকে সারা দেশে শুরু হয়েছে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। তবে গতকাল আমিন জুট মিল ছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলের ছয়টি পাটকল উৎপাদন শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন বিজেএমসির একজন কর্মকর্তা। ঢাকার ছয়টি ও খুলনার নয়টি পাটকল এখনো বন্ধ।

বকেয়া বেতন-ভাতার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজেএমসির চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ নাছিম গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বকেয়া বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য দুই সপ্তাহ আগে আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ৩৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছি। আশা করছি শিগগির বরাদ্দ পাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে ইতিবাচক ইঙ্গিত পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে খুবই আন্তরিক। টাকাটা পেলে ২০১০ সালের মজুরিকাঠামো অনুযায়ী আগামী জুন মাস পর্যন্ত শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, মজুরি ইত্যাদি দেওয়া যাবে।’

বিজেএমসির চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘ঈদের আগেই শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি দেওয়া হবে। নতুন মজুরিকাঠামো অনুযায়ী বেতনকাঠামো পুনর্মূল্যায়ন করার পর বাড়তি বেতন-মজুরি দেওয়া হবে।’

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিজেএমসি আওতায় ২৬টি পাটকলের মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন–জুট কারখানা। পাটকলগুলোতে গত বছরের জুন পর্যন্ত ২৭ হাজার ৭২১ জন স্থায়ী শ্রমিক এবং ৩ হাজার ৭৩০ জন কর্মচারী ও কর্মকর্তা ছিলেন। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত ২৩ হাজার ২৭৮ জন বদলি শ্রমিক ও ৬ হাজার ৫৪৮ জন দৈনিকভিত্তিক শ্রমিক কাজ করেন।

লোকসানের চক্র থেকে বের হতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ২২টি পাটকল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাটকলগুলো ৪৬৬ কোটি টাকার লোকসান গুনেছে এবং চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসেই লোকসান হয়েছে ৩৯৫ কোটি টাকা।

>

শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ৯ থেকে ১২ সপ্তাহের বাকি
বকেয়া দিতে ৩৩৮ কোটি টাকা চায় করপোরেশন
১৩ মে থেকে সরকারি পাটকলের চাকা ঘুরছে না
চলতি অর্থবছরের আট মাসে ৩৯৫ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল

বিজেএমসি জানায়, দুই অর্থবছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর আয় কমছে। পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি ও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা আয় করে পাটকলগুলো। পরের অর্থবছরে সেটি কমে ১ হাজার ১৯০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। গত বছর আরও কমে আয় হয়েছে ১ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা।

গত অর্থবছরে বিজেএমসির আয় ছিল ১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৪ শতাংশ বা ৬৩৯ কোটি টাকা শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তার মজুরি ও বেতন বাবদ ব্যয় হয়েছে। বর্তমানে শ্রমিকের মাসিক মূল মজুরি ৪ হাজার ১৫০ টাকা। ২০১৫ সালের মজুরি স্কেল বাস্তবায়িত হলে মাসিক নিম্নতম মজুরি ৮ হাজার ৩০০ টাকায় দাঁড়াবে।

বিজেএমসির কর্মকর্তা ও শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি পাটকলে লোকসানের বড় কারণ কাঁচা পাট কেনায় অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। পাটকলগুলো পাট কেনে দেরিতে ও বেশি দামে। এ ছাড়া সরকারি পাটকলের উৎপাদনশীলতা কম, উৎপাদন খরচ বেশি, যন্ত্রপাতি পুরোনো এবং বেসরকারি খাতের তুলনায় শ্রমিকের মজুরি বেশি। লোকসান ও অব্যবস্থাপনার কারণে শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারে না পাটকলগুলো। অবিক্রীত পণ্য গুদামে পড়ে থাকে।

আরও জানা গেছে, প্রতিবছরই পাটের মৌসুমে কাঁচা পাট কিনতে ও শ্রমিকের বেতন-ভাতা দিতে সরকারের কাছে হাত পাততে হয় বিজেএমসিকে। গত এক দশকে আর্থিক সংকট কাটাতে করপোরেশনকে ৭ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক সোহরাব হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের বিষয়ে বিজেএমসি কোনো আশ্বাস দেয়নি, আমাদের সঙ্গে কোনো বৈঠকও করেনি। বকেয়া বেতন-ভাতা না পাওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।’ চট্টগ্রামে পাটকল চালুর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঢাকা ও চট্টগ্রামে যা–ই হোক না কেন, বেতন-ভাতা না পাওয়ার আগে খুলনার পাটকলের চাকা ঘুরবে না।’