'লাইফ সাপোর্টে' শতবর্ষী বিমানশিল্প
করোনাভাইরাসের (কোভিড–১৯) বৈশ্বিক সংক্রমণের কারণে প্রথমেই যেসব খাতে ভয়াবহ প্রভাব পড়ে, তার মধ্যে বিমান পরিবহনসেবা অন্যতম। বাণিজ্যিকভাবে বিমান পরিবহন চালু হওয়ার ১০০ বছরের ইতিহাসে এই খাত এমন বিপর্যয়ের মুখে আর কখনো পড়েনি। যে কারণে বলা হচ্ছে, বৈশ্বিক বিমান পরিবহনসেবা এখন ‘লাইফ সাপোর্টে’ আছে। সেবা বন্ধ থাকা ও আর্থিক বিপর্যয়ের পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক বিমান সংস্থাগুলো একের পর এক নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছে। অধিকাংশ কোম্পানিই বাধ্য হয়ে নিজেদের বহরের বিমানগুলো বসিয়ে রেখেছে, কোনো কোনো সংস্থা দেদার কর্মী ছাঁটাই করছে, কেউবা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাচ্ছে কর্মীদের, আবার সব পদক্ষেপই নিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিমান সংস্থা ভার্জিন এয়ারলাইনস সম্প্রতি ৬০০ পাইলট বা বৈমানিকসহ ৩ হাজার জনবল ছাঁটাই করেছে।
ভার্জিন অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা তো আরও খারাপ। তারা এরই মধ্যে নিজেদর দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্য আদালতে আবেদন করেছে। ইতিমধ্যে একই পথে হেঁটেছে সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজ। সেটিও দেউলিয়া হয়ে গেছে।
এমন অবস্থা পুরো বিশ্বের এয়ারওয়েজ, মানে বিমান সংস্থাগুলোর। ফিনল্যান্ডভিত্তিক এয়ারওয়েজ ফিনার ১২টি উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি বাতিল করেছে। সেই সঙ্গে ২ হাজার ৪০০ কর্মীকে অব্যাহতি দিয়েছে তারা।
ইউরোপের অন্যতম বড় এয়ারওয়েজ রায়ানএয়ার ১১৩টি প্লেন বসিয়ে রেখেছে। তারা ৯০০ পাইলটকে অব্যাহতি দিয়েছে। আগামী মাসগুলোতে তারা আরও সাড়ে চার শ পাইলট ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করছে। নরওয়েজিয়ান এয়ারওয়েজ তো একেবারেই বসে গেছে। তাদের বহরে থাকা ৭৮৭টি উড়োজাহাজ ইজারাদারদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মরিশাসের এয়ার মরিশাস টিকে থাকার জন্য প্রশাসনের শরণাপন্ন হয়েছে।
স্ক্যান্ডিন্যাভিয়ান এয়ারলাইনস এসএএস ইতিমধ্যে ১৪টি বিমান ফিরিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি তারা ছাঁটাই করেছে ৫২০ জন বৈমানিককে। বর্তমানে স্ক্যান্ডিন্যাভিয়ান দেশগুলো এসএএস ও ইতিমধ্যে বসে যাওয়া নরওয়েজিয়ান এয়ারওয়েজের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে নতুন একটি কোম্পানি খোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দ্বিতীয় জাতীয় বিমান সংস্থা ইতিহাদ এয়ারওয়েজ এয়ারবাসের এ৩৫০ মডেলের ১৮টি উড়োজাহাজের ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে। বসিয়ে রেখেছে এ ৩৮০ মডেলের ১০টি এবং বোয়িং ৭৮৭ মডেলের আরও ১০টি উড়োজাহাজ। এ ছাড়া ছাঁটাই করেছে ৭২০ জন কর্মী।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) বৃহত্তম জাতীয় বিমান সংস্থা এমিরেটস বসিয়ে দেখেছে তাঁদের ৩৮টি এয়ারবাস। ১৫০ বোয়িং ৭৭৭এক্স নেওয়ার সবগুলো ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে তারা। এটি ছিল বিশ্বে বিমান কেনাবেচার ইতিহাসে বৃহত্তম চুক্তি। এ ছাড়া ৫৬ বছরের বেশি বয়সী সব কর্মীকে অবসরে পাঠাচ্ছে তারা।
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্যারেন্ট বা মূল কোম্পানি আইএজি এয়ার ইউরোপা কেনার চুক্তি থেকে সরে এসেছে। তবে চুক্তি প্রত্যাহারের কারণে তারা ৪ কোটি ইউরো ক্ষতিপূরণ দেবে। তারা ৩৪টি উড়োজাহাজ বসিয়ে রেখেছে এবং ৫৮ বছরের বেশি বয়সী সব কর্মীকে অবসরে পাঠাচ্ছে তারা। আর আইএজি লাইবেরিয়া বর্তমানে ৫৬টি বিমান বসিয়ে রেখেছে।
লুক্সেমবার্গের লাক্সএয়ার এয়ারলাইনস তার বহর ৫০ শতাংশ কমিয়েছে। দেউলিয়া হওয়ার পথে জার্মানির স্বল্প বাজেটের এয়ারওয়েজ ইউরোউইংস। ব্রাসেলস এয়ারওয়েজ তার বহর থেকে ৫০ শতাংশ বিমান কমানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
ইউরোপীয় দেশ হাঙ্গেরির স্বল্প বাজেটের বিমান সংস্থা উইজ এয়ার এ৩২০ মডেলের ৩২টি বিমান ফিরিয়ে দিচ্ছে। বিমান সংস্থাটি ১ হাজার ২০০ জনবল ছাঁটাই করেছে। এর মধ্যে ২০০ বৈমানিক রয়েছেন। আগামী মাসগুলোতে আরও ৪৩০ জনবল ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা রয়েছে উইজ এয়ারের। তবে যেসব কর্মীদের চাকরি থাকবে তাঁদের বেতন ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যভিত্তিক কার্গো এয়ার মানে পণ্য পরিবহনকারী বিমান সংস্থা মাত্র পাঁচটি রেখে বাকি সব কার্গো বিমান বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে।
জার্মানির বৃহত্তম বিমান সংস্থা লুফথানসা দুই কিস্তিতে তাদের ৭২টি এয়ারক্র্যাফট গ্রাউন্ডেড করবে, অর্থাৎ বসিয়ে দেবে।
ফ্রান্সভিত্তিক আঞ্চলিক বিমান সংস্থা এয়ার ফ্রান্স হপ তাদের বিমান বহর ও জনবল দুটোই ৫০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে এখন।
এদিকে একরকম খেল চলছে থাই ওয়ারওয়েজ নিয়ে। গতকাল সোমবার কোম্পানিটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আদালতে আবেদন করেছে এই বিমান সংস্থা। পরে এ তথ্য সঠিক নয় বলে বিবৃতি দেয় বিমান সংস্থাটি। তারা জানায়, পুনর্গঠনের জন্য আবেদন করেছে তারা। বোঝা যাচ্ছে, এয়ারলাইনসটি বাঁচাতে বড় আকারের প্রণোদনা দিতে চলেছে থাই সরকার। ধারণা করা হচ্ছে, প্রণোদনার আকার হবে ২৬০ কোটি মার্কিন ডলার, যা থাইল্যান্ডের স্থানীয় মুদ্রায় ৫৮ দশমিক ১ বিলিয়ন বাথ।
এ ছাড়া থাইল্যান্ডের এয়ারলাইনস ইউ ২২টি উড়োজাহাজ বসিয়ে রেখেছে এবং ৪ হাজার ১০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে।
এদিকে ইউরোপভিত্তিক বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস এখন এ৩৫০ মডেলের ১৮টিসহ ৬০টি নতুন এয়ারক্র্যাফট বা বিমান তৈরি করে বসে আছে, কিন্তু কোনো ক্রেতা নেই।
সব মিলিয়ে আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ বিশ্বজুড়ে আট হাজার বিমান গ্রাউন্ডেড হবে, মানে এগুলোর উড্ডয়ন বন্ধ হয়ে যাবে। এতে বেকার হবেন ৯০ হাজার পাইলট বা বৈমানিক।
সূত্র: হংকং নিউজ, স্যাম চুই, এশিয়ান অ্যাভিয়েশন।