ইউক্রেনে রুশ হামলার জেরে গত বুধবার রাশিয়ায় নিজেদের পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দেয় বিশ্বখ্যাত পোশাকের খুচরা বিক্রেতা ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম। সেই রেশ না কাটতেই রাশিয়ায় পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে চলমান ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে ব্র্যান্ডটির এ দেশীয় কার্যালয়।
পোশাকশিল্পের একজন উদ্যোক্তা গত রোববার রাতে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদককে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, এইচঅ্যান্ডএমের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইথিওপিয়ার প্রধান জিয়াউর রহমান এক ই-মেইল বার্তায় চলমান ক্রয়াদেশ স্থগিত রাখার কথা জানান।
এইচঅ্যান্ডএমের সেই বার্তায় বলা হয়েছে, এইচঅ্যান্ডএম গ্রুপ রাশিয়ায় সাময়িকভাবে পণ্য বিক্রি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চুক্তিবদ্ধ জাহাজ কোম্পানিগুলো রাশিয়ায় তাদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে। এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়ার বাজারের জন্য দেওয়া ক্রয়াদেশ (এইচঅ্যান্ডএমের সবগুলো ব্র্যান্ডের ক্রয়াদেশ) পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। পরিবহন সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলো পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কোনো ক্রয়াদেশের পণ্য নেবে না।
ব্র্যান্ডটির ই-মেইল বার্তায় আরও বলা হয়েছে, এইচঅ্যান্ডএমের সবগুলো ব্র্যান্ড রাশিয়ার জন্য দেওয়া ক্রয়াদেশের পণ্য নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি সমাধান ও পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পন্ন করার লক্ষ্য রয়েছে। ক্রয়াদেশ দেওয়ার সব পণ্যের দায়ভার নেবে এইচঅ্যান্ডএম সেটিও স্পষ্ট করে বলা হয় বার্তায়।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে ইউক্রেনের রুশ সেনাদের অভিযান শুরু হয়। এরপর পশ্চিমা দেশগুলো একজোট হয়ে রাশিয়ার ওপর নানামুখী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর মধ্যে একটি নিষেধাজ্ঞা সুইফট লেনদেন ব্যবস্থা থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বের করে দেওয়া। এ জন্য রপ্তানিকারকেরা পণ্য রপ্তানি করেও সময়মতো অর্থ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে ১ মার্চ থেকে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানি মেডিটেরিয়েন শিপিং কোম্পানি (এমএসসি) রাশিয়াতে পণ্য পরিবহন বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর ডেনমার্কভিত্তিক মার্সক, জার্মানিভিত্তিক হ্যাপাগ লয়েড এবং সিঙ্গাপুর-জাপানভিত্তিক ওয়ান লাইনও একই পদক্ষেপ নেয়। অন্য শিপিং কোম্পানিগুলো নিষেধাজ্ঞা না দিলেও তারা এখন বুকিং নিতে চাইছে না।
এমন পরিস্থিতিতে গত বুধবার রাশিয়ায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে এইচঅ্যান্ডএম। এক বিবৃতিতে কোম্পানিটি জানায়, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর কারণে রাশিয়ায় সব ধরনের পণ্য বিক্রি কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত থাকবে। বিক্রি বন্ধের মাধ্যমে তারা ‘দুর্ভোগগ্রস্ত সমস্ত লোকের সঙ্গে’ দাঁড়িয়েছে বলে জানায়। এর আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর পরপরই গ্রাহক ও কর্মীদের নিরাপত্তার কারণে ইউক্রেনের বিক্রয়কেন্দ্র অস্থায়ীভাবে বন্ধ করে এইচঅ্যান্ডএম।
রাশিয়ায় ব্র্যান্ডটির সাময়িক বিক্রি বন্ধ করা নিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এইচঅ্যান্ডএমের ষষ্ঠ বৃহত্তম বাজার হলো রাশিয়া। বর্তমানে ১৫০টির বেশি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে সেখানে। গত বছরের শেষ প্রান্তিকে কোম্পানিটির মোট বিক্রির ৪ শতাংশ হয়েছে রাশিয়ায়। সেই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের শুরুতে এই গ্রুপের একাধিক ব্র্যান্ডের আরও কয়েকটি বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছিল এইচঅ্যান্ডএম। এখন সেসব দোকানেও বিক্রি বন্ধ রয়েছে।
এইচঅ্যান্ডএমের ক্রয়াদেশ স্থগিত করা নিয়ে জানতে চাইলে এইচঅ্যান্ডএমের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইথিওপিয়ার প্রধান জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কোনো ক্রয়াদেশ বাতিল করিনি। রাশিয়ার জন্য আমাদের দেওয়া সব ক্রয়াদেশের পণ্য আমরা নেব। প্রয়োজনে সেটি অন্য গন্তব্যে পাঠানো হবে।’
বাংলাদেশে প্রায় ২৫০টি পোশাক কারখানায় পণ্য তৈরি করে এইচঅ্যান্ডএম। তবে রাশিয়ার জন্য কয়টি কারখানা পোশাক তৈরি করছে সেটি জানাতে রাজি হননি জিয়াউর রহমান।
পোশাকশিল্পের মালিকেরা জানান, রাশিয়ায় পোশাক রপ্তানি করে এমন কিছু কারখানা সমস্যায় পড়েছে। যদিও মোট পোশাক রপ্তানির মাত্র পৌনে ২ শতাংশের গন্তব্য রাশিয়া। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ২ হাজার ৩৯৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। তার মধ্যে রাশিয়ায় গেছে ৪২ কোটি ডলারের পোশাক।
এইচঅ্যান্ডএম ক্রয়াদেশ স্থগিত করার বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি শুনেছি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এইচঅ্যান্ডএম আমাদের কিছু জানায়নি।’ তিনি বলেন, ‘আশা করছি, এইচঅ্যান্ডএম ক্রয়াদেশ স্থগিত করায় বড় কোনো সমস্যা হবে না। তারা হয়তো অন্য কোনো গন্তব্যে এসব পণ্য নিয়ে যাবে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ফারুক হাসান বলেন, ‘আমাদের কাছে সাতটি সদস্য প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, রাশিয়ায় পোশাক রপ্তানি করে তাদের মোট ৪০ লাখ ডলার আটকে গেছে। তবে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের কাছে যারা পোশাক রপ্তানি করেছে তারা অর্থ পাচ্ছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে আমরা সচেতন রয়েছি। সরকারের বিভিন্ন মহলেও আমরা কথা বলেছি।’
এইচঅ্যান্ডএম বাংলাদেশে প্রায় তিন দশক ধরে ব্যবসা করছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে বছরে তারা ৩০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে। ওই বছর বাংলাদেশের মোট পোশাক রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি ডলারের।
১৯৪৭ সালে যাত্রা শুরু করা হ্যানস অ্যান্ড মৌরিটজ এবি, সংক্ষেপে এইচঅ্যান্ডএম। গ্রুপটি বর্তমানে বিশ্বে পোশাকের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় খুচরা বিক্রেতা ব্র্যান্ড। ৭৫টি বাজারে তাদের ৪ হাজার ৮০১টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। ৫৪টি দেশে অনলাইনেও পণ্য বিক্রি করে এইচঅ্যান্ডএম গ্রুপ। তাদের সহযোগী ব্র্যান্ডের মধ্যে এইচঅ্যান্ডএম, কস, মনকি, এইচঅ্যান্ডএম হোম, উইকডে, আদার স্টোরিজ অন্যতম।