২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

মুনাফার ফাঁদ ফেলে যে প্রতারণা

  • পঞ্জি স্কিম এখন খুব পরিচিত একটি শব্দ। এককথায় এটি একটি প্রতারণামূলক বিনিয়োগ কার্যক্রম।

  • পঞ্জি স্কিমের মতো দুর্নীতিগুলো আসলে টের পাওয়া কঠিন। বেশির ভাগ সময় ভেতরের কোনো মানুষ ঘটনাটা জানালে তা প্রকাশ পায়।

  • বেশির ভাগ পঞ্জি স্কিমের সাধারণ কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকে। যা দেখে এর সম্পর্কে আগে থেকে বুঝতে পারেন বিনিয়োগকারীরা।

চালর্স পঞ্জিকে নিয়ে ১৯২০ সালের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ
ছবি: সংগৃহীত

১৯২০ সালের দিকে যুক্তরাজ্যের বোস্টনে বেশ হইচই ফেলেন এক ব্যক্তি। ইতালির অভিবাসী চার্লস পঞ্জি নামের ওই ব্যক্তির ‘সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি’ দারুণ মুনাফার অফার দিতে থাকে বিনিয়োগকারীদের জন্য। বিনিয়োগকারীরাও হামলে পড়েন তাতে।

সে সময় বিভিন্ন দেশের ডাক বিভাগ নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক কুপন ব্যবহার করত চিঠিপত্র বিনিময়ের জন্য। এই কুপনগুলোর স্থানীয় মুদ্রামান একই থাকত। তবে মুদ্রার বিনিময় মূল্যের ওঠা-নামার কারণে অনেক সময় অন্য দেশে আন্তর্জাতিক কুপনের মান বেড়ে বা কমে যেত। প্রথমে চার্লস পঞ্জি ঠিক এ সুযোগটাই নেন। পঞ্জি ইউরোপে কিছু এজেন্ট নিয়োগ করেন। যাঁদের দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে এসব কুপন কম মূল্যমানের মুদ্রায় কিনে নিতেন। সস্তায় কিনে নেওয়া এসব কুপন, ব্যয়বহুল ডাকটিকিটের সঙ্গে বিনিময় করতেন। এই দুই মূল্যের ব্যবধানে বেশ মোটা একটা মুনাফা নিজের পকেটে ভরতেন তিনি। এখানে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হতেন মুনাফার জন্য। সে সময় ব্যাংকে টাকা রাখলে বার্ষিক মুনাফা মিলত ৫ শতাংশ। সে জায়গায় পঞ্জির কোম্পানিতে আন্তর্জাতিক কুপন কিনলে ৫০ শতাংশ মুনাফা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়, তা–ও আবার মাত্র ৯০ দিনে। তবে এ পর্যন্ত আইনত কোনো সমস্যা ছিল না। একসময় লোভ বাড়তে থাকল পঞ্জির। লোভের সঙ্গে বুদ্ধিও অনেক তাঁর। ৫ ফুট ২ ইঞ্চির ছোটখাটো এই মানুষটি নিজের বুদ্ধি আর মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলতে শুরু করলেন।

চালর্স পঞ্জি
ছবি: সংগৃহীত

‘সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি’ খুলে বসলেন। বিনিয়োগকারীদের ৪৫ দিনে ৫০ শতাংশ অথবা ৯০ দিনে ১০০ শতাংশ মুনাফার প্রস্তাব দিলেন। এখানে মজার বিষয় হলো, এই কোম্পানিতে পঞ্জির খুব কমই বিনিয়োগ ছিল। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে জমা নেওয়া অর্থই তিনি নানাভাবে পুনর্বণ্টন করে দিতেন, যাতে তাঁরা বিশ্বাস করেন যে স্কিমটি সত্যিই ভালো মুনাফা করতে সক্ষম। বিষয়টি আর কিছুই নয়, আজকের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ গতকালের বিনিয়োগকারীদের ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করা। পঞ্জির স্কিমে বিনিয়োগ করার জন্য মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে। তার এই স্কিমটি প্রায় এক বছর চলে। এর মধ্যে হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর মধ্যে পঞ্জি সহজে অর্থ উপার্জনের পথ বাতলে দিচ্ছেন—এমন বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেন। আট মাসে নিজের পকেটে ঢোকান দেড় কোটি ডলার। এরপর বিষয়টির দিকে চোখ যায় কর্তৃপক্ষের। তারা স্কিমটি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। বের হয়ে আসে স্কিমটি হলো অনেকটা ফাঁপা বেলুনের মতো। এতে আসল কোনো বিনিয়োগ নেই।

কীভাবে চলে পঞ্জি স্কিম
পঞ্জি স্কিম এখন খুব পরিচিত একটি শব্দ। এককথায় এটি একটি প্রতারণামূলক বিনিয়োগ কার্যক্রম। পঞ্জির নামেই এটির নামকরণ। এ ধরনের স্কিমে বিপুল মুনাফার লোভ দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের টানা হয়। বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহী হন, কারণ সামান্য বিনিয়োগ করে অনেক মুনাফা পাচ্ছেন, এমন বোধ তৈরি হয় তাঁদের মধ্যে। তবে বিষয়টি হলো একেবারেই নয়ছয়। নতুন বিনিয়োগকারীদের জমা অর্থই পুরোনো বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়। পঞ্জি স্কিমের আয়োজকেরা বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি ছাড়াই সামান্য বিনিয়োগে অতিমাত্রায় মুনাফা অর্জনের প্রতিশ্রুতি দেন। একটি পঞ্জি স্কিম টিকিয়ে রাখতে অবিচ্ছিন্ন তহবিলের প্রয়োজন হয়। তাই নতুন বিনিয়োগকারীই টিকিয়ে রাখে স্কিমটি। অর্থাৎ স্কিমের আকার যত বড় হতে থাকে নতুন বিনিয়োগকারীদের সংখ্যাও তত বাড়তে থাকে। স্কিমে বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণও বাড়তে থাকে। এখানে মজার বিষয় হচ্ছে, মুনাফা তাঁরাই পান যাঁরা এই স্কিমের একদম প্রথমের দিকে থাকেন। যত নতুন সদস্য যোগ হয় স্কিমের আকার বড় হতে থাকে। এ ধরনের ব্যবসা শুধু মানুষের লোভের ওপর ভিত্তি করে টিকে থাকে। ব্যবসার স্থায়িত্ব নির্ভর করে নতুন সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির ওপর। যখন নতুন বিনিয়োগকারী আর পাওয়া যায় না, পঞ্জি স্কিম ভেঙে পড়তে শুরু করে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। পঞ্জি স্কিমের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে থাকে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। কারণ অল্প ঝুঁকিতে দ্রুত ধনী হওয়ার টোপ গেলেন তাঁরা।

চালর্স পঞ্জিকে নিয়ে ১৯২০ সালের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ
ছবি: সংগৃহীত

পঞ্জি স্কিমের লাল ঝান্ডা
বেশির ভাগ পঞ্জি স্কিমের সাধারণ কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন—১. অল্প বিনিয়োগ আর ঝুঁকি ছাড়া অধিক মুনাফার আশ্বাস ২. অতিরিক্ত ধারাবাহিক রিটার্ন ৩. অনিবন্ধিত বিনিয়োগ ৪. লাইসেন্সবিহীন বিক্রেতারা ৫. গোপনীয়, পরিশীলিত কৌশল ৬. আয়ের প্রবৃদ্ধি এবং ব্যবসা সম্প্রসারণ পরিকল্পনার অস্পষ্ট বর্ণনা ও ৭. বিনিয়োগকারীদের স্বল্প জ্ঞানের সুবিধা নেওয়া। অনেক সময় সচেতনতা বৃদ্ধি ও কঠোর করার নিয়ম সত্ত্বেও বিনিয়োগকারীরা এর ফাঁদে পড়েন।

আসলে যেকোনো স্কিম যা ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি ফেরতের প্রতিশ্রুতি দেয় তাতে সন্দেহ বা সংশয় সৃষ্টি হওয়া জরুরি। বিশ্লেষকেরা বলেন, অস্বাভাবিক রিটার্ন বা স্বল্প সময়ে বিনিয়োগের পরিমাণ দ্বিগুণ বা তিন গুণ করার প্রতিশ্রুতি পঞ্জি স্কিমের মূল বৈশিষ্ট্য। পঞ্জি স্কিমগুলো ধারাবাহিকভাবে উচ্চ মুনাফা বা অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। আগ্রহীদের প্রথম সেটার ফাঁদে ফেলার জন্য প্রাথমিকভাবে প্রতিশ্রুতি রাখে। বিনিয়োগকারীরা যখন তহবিলের প্রবাহকে টিকিয়ে রাখার জন্য বন্ধু এবং আত্মীয়দের তালিকাভুক্ত করে ফেলে তখন নতুন মুখোশ নেয়। বিনিয়োগকারী না থাকলে এ ধরনের ব্যবসায়ের মূল সমস্যা উদ্যোক্তার বিনিয়োগ খুবই কম থাকে। এ ছাড়া পঞ্জি স্কিম তাদের প্রস্তাবিত ‘গ্যারান্টি’ কথাটির কারণে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। আপনাকে আসলে ভাবতেই হবে এ যুগে এত গ্যারান্টি কে দেয়।

পঞ্জি স্কিমের মুখোশ উন্মোচিত হয় যেভাবে
পঞ্জি স্কিমের মতো দুর্নীতিগুলো আসলে টের পাওয়া কঠিন। বেশির ভাগ সময় ভেতরের কোনো মানুষ ঘটনাটা জানালে তা প্রকাশ পায়। অভ্যন্তরীণ কেউ যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ভেতরের কথা জানালে পর্দা ফাঁস হয়। অবশ্য আরও একটি কারণ আছে। বিনিয়োগকারীর সংখ্যার ওপর পঞ্জি স্কিম চলে। একসময় ঠিকই মুখ থুবড়ে পড়ে। যখন নতুন বিনিয়োগকারী এতে আর অর্থ বিনিয়োগ করেন না, এটি থামতে বাধ্য হয়। অর্থের উৎস বা তারল্য কমে যাওয়ায় এটি আর চালানো সম্ভব হয় না। এতে উদ্যোক্তার নিজের বিনিয়োগ এত কম থাকে নিজের আখের গুছিয়েই সে পালিয়ে যায়। আবার অনেক সময় অনেকে মূল টাকা ফেরত পেতে তাগাদা দিতে শুরু করে। তখন বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যায়।

যা লক্ষ রাখতে হবে
হয়তো প্রথম বিনিয়োগ করছেন, কঠোর পরিশ্রমের অর্থ কোনো স্কিমে বিনিয়োগে করার আগে কিছু প্রশ্ন মাথায় রাখা উচিত। আপনি যখন আপনার পরবর্তী বিনিয়োগের সুযোগটি বিবেচনা করবেন তখন এই প্রশ্নগুলো দিয়ে শুরু করুন।

  • ঝুঁকি ও মুনাফার তুলনা: প্রতিটি বিনিয়োগেই কিছুটা ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে অধিক মুনাফা পাওয়া যায় এমন বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকে বেশি। তাই কোনো ‘গ্যারান্টিযুক্ত’ বিনিয়োগের সুযোগ সম্পর্কে সন্দেহ রাখা উচিত।

  • বিক্রেতার লাইসেন্স আছে কি না: যেকোনো দেশের আইন অনুযায়ী পেশাদারি বিনিয়োগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার লাইসেন্স থাকা বা নিবন্ধিত হওয়া প্রয়োজন। বেশির ভাগ পঞ্জি স্কিমে লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তি বা অনিবন্ধিত সংস্থাগুলো জড়িত থাকে।

  • বিনিয়োগ কি আমি বুঝি: আপনি যে বিনিয়োগ বুঝতে পারেন না, তা এড়িয়ে চলায় ভালো। কোনো বিনিয়োগের আগে তা সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা থাকা উচিত। আপনি কেন বিনিয়োগ–সম্পর্কিত লিখিত তথ্য পর্যালোচনা করতে পারবেন না, সে সম্পর্কে অজুহাত গ্রহণ করা যাবে না।

  • সন্দিহান হোন: আপনি যদি কোনো অর্থ প্রদান না করেন বা আপনার বিনিয়োগ নগদ করতে অসুবিধা হয় তবে সন্দেহ করা জরুরি। মনে রাখবেন যে পঞ্জি স্কিমের প্রবর্তকেরা নিয়মিত অংশগ্রহণকারীদের বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করেন। কখনো কখনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া পরিমাণের চেয়েও বেশি রিটার্ন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন।