মালা শাড়ি, ২৫০ ছাত্রী ও র্যাগ ডের গল্প
‘মালা শাড়ি না দিলে বিয়ে করুম না’—একসময় বিজ্ঞাপনের এই জিঙ্গেল ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। বিয়ে মানেই ছিল অবধারিত মালা শাড়ি। ১৯৬৮ সালে প্রথম বাজারে আসে মালা শাড়ি। বাংলাদেশি সিল্কের সুন্দর এই শাড়ি পরেই শহরে-গ্রামে আমাদের মা-খালাদের অনেকেরই বিয়ে হয়েছে। এখনো দেশের অনেক মেয়ের আলমারিতে সযত্নে ভাঁজ করে রাখা আছে মায়ের বিয়ের স্মৃতিস্বরূপ এই মালা শাড়ি।
গত মঙ্গলবার রাতে মারা গেছেন এই মালা শাড়ির রূপকার দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন। আনোয়ার গ্রুপ এখন বস্ত্র, পাট, সিমেন্ট, ইস্পাত, ব্যাংক, বিমা, গাড়ি, আবাসন, অবকাঠামো, আসবাবসহ ৩৬টি পণ্য ও সেবা খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। গ্রুপটির অধীনে প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অবশ্য এসব আনোয়ার হোসেনের মূল পরিচয় নয়। তাঁর পরিচয়, তিনি গুটিকয়েক বাঙালি উদ্যোক্তার একজন, যাঁদের হাত ধরে বাংলাদেশের আজকের শিল্প-সক্ষমতা গড়ে উঠেছে।
আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক জানিয়ে পোস্ট করেছেন অনেক নারী। অনেকেই লিখেছেন মালা শাড়ি নিয়ে তাঁদের আবেগের কথা। তবে আনোয়ার হোসেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চমৎকার একটি গল্প লেখেন শিরিন হোসেন। শিরিন হোসেন ইউনিসেফ কমিউনিকেশন ফর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে কর্মরত ছিলেন। এখন অবসরে আছেন। উনি জানান, আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না, তবে একটা ঘটনার কারণে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর কাছে। পরে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায় সেই গল্পের পুরোটা।
শিরিন হোসেন জানান, ঘটনাটি ১৯৮০ সালের। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। থাকতেন রোকেয়া হলে। সে সময় মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষা দেবেন। তো বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতি অনুযায়ী হলের ‘র্যাগ ডে’ আয়োজনের পরিকল্পনা করেন তাঁরা বেশ কয়েকজন মিলে। আলোচনা করে ঠিক হয়, র্যাগ ডে উপলক্ষে র্যালি, রং খেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং নৈশভোজ আয়োজন করা হবে। তবে পুরো অনুষ্ঠানে কীভাবে নতুনত্ব আনা যায়, তা নিয়ে ভাবতে বসলেন শিরিন হোসেনরা। এমন কিছু করতে চাইলেন, যা সবাইকে চমকে দেবে। সেই চিন্তা থেকেই তাঁরা বেছে নিলেন ‘মালা শাড়ি’। মালা শাড়ি তখন এক ব্র্যান্ড। বিয়ের সময় নারীদের প্রথম পছন্দ। তবে র্যাগ ডের অনুষ্ঠানে মালা শাড়ি, এমনটা ভাবাই যায় না। কিন্তু রোকেয়া হলের ছাত্রীরা সেটাই ভাবলেন।
র্যাগ ডে–তে মালা শাড়ি পরার সিদ্ধান্ত তো হলো। কিন্তু এতগুলো শাড়ি কোথায় পাওয়া যাবে? চিন্তায় পড়লেন ছাত্রীরা। পুরো আয়োজনের জন্য কম করে হলেও ২৫০ শাড়ি লাগবে। অবশেষে সবাই মিলে ঠিক করলেন, শাড়ির জন্য তাঁরা যাবেন আনোয়ার হোসেনের কাছে। তাঁর সঙ্গে দেখা করে অনুষ্ঠানের স্পনসর হওয়ার অনুরোধ করবেন। তখন অবশ্য স্পনসরের ধারণাটি সেভাবে প্রচলিত ছিল না। মূলত অনুষ্ঠানের জন্য উপহার হিসেবেই আনোয়ার হোসেনের কাছে ২৫০ মালা শাড়ির চাওয়ার কথা ভাবলেন তাঁরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৫-৬ জন ছাত্রী গেলেন আনোয়ার গ্রুপের অফিসে। বিনা নোটিশে। এ দলে ছিলেন শিরিন হোসেনও। সঙ্গে তখনকার বাংলা বিভাগের পাপড়ি, মনোবিজ্ঞান বিভাগের সালমা বানু, দর্শনের জিনাত সুলতানাসহ আরও কয়েকজন। মনে মনে বেশ ভয় কাজ করছিল তাঁদের। একে তো আগে থেকে বলে আসেননি, তার ওপর এতগুলো শাড়ি চাইতে গেছেন। এত বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথাবার্তা ছাড়া হুট করে গিয়ে দেখা করা এবং কথা বলা সহজ কাজ ছিল না। আনোয়ার গ্রুপের তখনকার প্রশাসনিক কর্মকর্তা তো ভেতরে ঢুকতেই দিচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে ছাত্রীরা অনুরোধ করেন, আনোয়ার সাহেবকে আমাদের কথা আর আসার উদ্দেশ্যটা জানান। উনি দেখা করতে না চাইলে আমরা চলে যাব।
তবে আনোয়ার সাহেবকে আমাদের কথা জানানোর পর উনি দেখা করতে রাজি হলেন। তাতে আমরা একটু আশ্চর্য হলেও মনে মনে আনন্দবোধ করলাম। সেই দিনের কথা স্মরণ করে শিরিন হোসেন বলেন, ‘আমরা কাঁচুমাচু করে উনার রুমে ঢুকলাম, বসলাম। আলাপে আলাপে উনার সঙ্গে পরিচিত হলাম। খুবই হাসিখুশি একজন মানুষ। আমাদের আবদার শুনে বেশ মজা পেয়েছেন বলে মনে হলো। আমাদের আবদার শুনে জানতে চাইলেন, শাড়ি দিলে উনার কী লাভ হবে?’ শত হলেও ব্যবসায়ী মানুষ। তাই লাভের খোঁজ করলেন। ছাত্রীরাও কম কিসে। ব্যবসায়ীর প্রশ্নের জবাব দিলেন ব্যবসায়িক লাভ-লোকসানের হিসাব কষে। আনোয়ার হোসেনকে ওই দিন ছাত্রীরা বলেছিলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স পড়ুয়া প্রায় ২৫০ ছাত্রী র্যালিতে মালা শাড়ি পরে বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), শাহবাগ, মেডিকেল কলেজ রোড প্রদক্ষিণ করবে—ভাবতে পারেন কেমন লাগবে? তাই এ আয়োজন মালা শাড়ির প্রচারণায় বিরাট সহায়ক হবে।’
ছাত্রীদের মুখে এমন একটি জবাব শুনে সেদিন আনোয়ার হোসেন আমাদের অনুরোধে র্যাগ ডের র্যালির জন্য মালা শাড়ি দিতে রাজি হয়েছিলেন বলে জানান শিরিন হোসেন। তিনি জানান, জরি পাড়ের টিয়া সবুজ, লাল, নীল, রানি গোলাপি, কমলা রঙের উজ্জ্বল সব শাড়ি উপহার দিলেন আনোয়ার হোসেন। তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়। রর্যাগ ডের দিন সকালে আনোয়ার হোসেন নিজে গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেখতে এসেছিলেন, ছাত্রীরা আসলেই শাড়ি পরেছে কি না। দূরে দাঁড়িয়ে ছাত্রীদের রর্যালি দেখে চলেও গিয়েছিলেন তিনি।
শিরিন হোসেনের সঙ্গে সেদিন ছিলেন দর্শনের ছাত্রী জিনাত সুলতানা। ওই ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে জিনাত হোসেন বলেন, ‘খুবই মজার একটা স্মৃতি ছিল সেটা। আনোয়ার হোসেন খুবই উদার মনের মানুষ ছিলেন। সবচেয়ে ভালো মানের শাড়ি আমাদের দিয়েছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এতগুলো মেয়েকে ঝলমলে এই শাড়িতে দেখে খুবই অবাক হয়েছিলেন। খুব রঙিন একটা দিন কাটিয়েছিলাম আমরা।’
আনোয়ার হোসেনদের পারিবারিক ব্যবসা ১৮৩ বছরের পুরোনো। পারিবারিক ব্যবসার দেখভালের পাশাপাশি নিজের ব্যবসা শুরু করেন ১৯৫৩ সালে। এরপর আর পিছু তাকাতে হয়নি। সত্তরের দশকে মালা শাড়ি দিয়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন। এরপর ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে আনোয়ার গ্রুপের।