মামুনের 'মধুময়' জীবন

সরিষাখেত থেকে মধু সংগ্রহ করছেন মামুনার রশিদ (চশমা পরিহিত)
সরিষাখেত থেকে মধু সংগ্রহ করছেন মামুনার রশিদ (চশমা পরিহিত)
>

কুষ্টিয়ার মামুনার রশিদের খামার থেকে এখন বছরে চার টন মধু সংগ্রহ করা হয়। তাঁর সংগৃহীত মধু যায় বিদেশেও।

মধু সংগ্রহ করতে করতে নাম এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে মানুষ তাঁর নাম দিয়েছে ‘মধু মামুন’। তাঁর নাম আসলে মামুনার রশিদ। বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়িয়া গেটপাড়া গ্রামে। জীবনে নানা চড়াই-উতরাইয়ের পর মধু সংগ্রহকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি। পথনাটকে অভিনয় অথবা চাকরি নয়, মধুই তাঁর জীবনে সচ্ছলতা এনেছে।

মামুনার রশিদের বয়স ৪৪ বছর। ১৯৯৭ সালে বাড়িতে একটি মৌমাছির চাক দেখে মধু সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। এরপর থেকে সরিষাসহ বিভিন্ন খেত থেকে মধু সংগ্রহ শুরু করেছেন। সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহের অভিজ্ঞতাও আছে। ২০১৫ সালে মেয়ের নামানুসারে গড়ে তুলেছেন ‘মিষ্টি মৌ খামার’। কুষ্টিয়া বিসিক থেকে মধু বাজারজাত করার লাইসেন্স বা সনদও নিয়েছেন। চলতি বছর মামুনার রশিদের খামার থেকে চার হাজার কেজি মধু সংগৃহীত হয়েছে। কেজিপ্রতি ৩৫০ টাকা দরে যার বাজারমূল্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা। মামুনের খামারে কাজ করে সাতজন লোক।

সম্প্রতি মিরপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাঠজুড়ে বিস্তীর্ণ সরিষার খেত। শীত মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গেই সরিষার খেতের পাশে মৌ চাষের বাক্স বসিয়েছেন মামুন। বাক্স থেকে মৌমাছির দল সরিষা খেতে উড়ে উড়ে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে আবার বাক্সে ফিরে আসছে। বাক্স থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হচ্ছে মধু। মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় জানায়, উপজেলাটিতে ৫৬০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ১২০ হেক্টর জমির সরিষা খেত মৌ চাষের আওতায় আনা হয়েছে। উপজেলার কৃষি কার্যালয় এ বছরও মামুনকে মৌ চাষের জন্য বাক্স দিয়েছে।

মামুন বলেন, দুই বছর ধরে তাঁর সংগৃহীত মধু অস্ট্রেলিয়াতেও পাঠানো হচ্ছে। সেখানে প্রবাসী এক ব্যক্তি এসব মধু নিয়ে বিক্রি করেন। গত বছর ৩০০ কেজি মধু পাঠানো হয়েছিল। এবার তারও বেশি মধু পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।

সম্প্রতি মামুনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানালেন, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ছিল তাঁর বিরল প্রতিভা। যাত্রাপালা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা, পথনাটক, একক নারী-পুরুষ কণ্ঠের গান—সবই করেছেন। মেজ ভাইয়ের হাত ধরে তিনি প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় সাগর সেচা মানিক নাটকে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রবেশ ঘটে। ১৯৮৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর মামুনের লেখাপড়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সে সময় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে পাঁচ শতাধিক পথনাটকে অভিনয় করে তা থেকে অর্জিত আয় দিয়ে পড়ালেখার খরচ জোগাতেন। পরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। পাশাপাশি ২০০২ সাল থেকে মধু সংগ্রহ শুরু করেন। ২০১১ সালে কিডনিতে পাথর হলে পেটের ভেতর গজ ও ব্যান্ডেজ রেখেই অপারেশন শেষ করেন চিকিৎসক। সেই ধকল সামলে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন। একপর্যায়ে বেসরকারি সংস্থার চাকরি ছেড়ে পুরোপুরিভাবে মধু সংগ্রহের ব্যবসায় মন দেন। মামুনের স্ত্রী রাশিদা আক্তার খুলনা বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী। মেয়ে মায়মুনা রশিদ মিষ্টি (১২) ও ছেলে আহানাফ তাহমিদ মুন (৯) পড়াশোনা করছে।

মামুনের মধু কুষ্টিয়াসহ আশপাশের জেলায় বিক্রি হয়। অনেকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে মধু কেনেন। মধু কিনতে যাওয়া আসলাম হোসেন বলেন, ভেজালের যুগে নিজ চোখে খাঁটি মধু উৎপাদন দেখে ও কিনতে পেরে ভালো লাগছে। তিনি প্রতি কেজি মধু ৩৫০ টাকা দরে ২০ কেজি মধু কিনে নেন।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, সরিষার খেতে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করলে পরাগায়ন ভালো হয়। এতে সরিষার ফলন বাড়ে।