ভয়ভীতি দেখিয়ে যেভাবে একটি পাটকল দখল

র‍্যাবের একজন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে জোর করে কোম্পানির শেয়ার লিখে নেওয়ার জের ধরে কারখানা বন্ধ। দেড় হাজার লোক তিন মাস ধরে বেকার।

দাহমাশী জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রবেশপথ

দাহমাশী জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের এক কোম্পানির চেয়ারম্যান নোমান চৌধুরী ভয়ভীতি দেখিয়ে একই কোম্পানিরই ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মৃধা মনিরুজ্জামান মনিরের মালিকানা লিখে নিয়ে গেছেন। আর এ কাজ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তার সাহায্য নিয়েছেন নোমান চৌধুরী।

মনিরুজ্জামান মনির পাট খাতের একজন শিল্পপতি, আর নোমান চৌধুরী জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার কামারখালীতে অবস্থিত শতভাগ রপ্তানিমুখী পাটসুতা উৎপাদনকারী এ কারখানা মনিরুজ্জামানের গ্রামের বাড়ির পাশে।

শুধু শেয়ার লিখে নেওয়া নয়, ভুয়া মামলা দিয়ে মনিরুজ্জামান এবং তাঁর ছেলে মেহেদী জামানকে হয়রানিও করে যাচ্ছেন নোমান চৌধুরী। আবার অভিজ্ঞতা না থাকায় চালু ও লাভজনক কোম্পানিটি তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে করোনার এই দুঃসময়ে দেড় হাজার শ্রমিক এখন বেকার।

নোমান চৌধুরী চক্রের কীর্তিকলাপের কথা জানিয়ে এবং এ থেকে প্রতিকার পেতে মনিরুজ্জামান গত ১৩ জুন পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) বেনজীর আহমেদকে লেখা একটি চিঠিতে এসব কথা বলেছেন। চিঠিতে মনিরুজ্জামান বলেছেন, ‘নোমান চৌধুরী বারবার হুমকি দিতে থাকেন এই বলে যে প্রশাসনের অনেক উচ্চপর্যায়ে তাঁর যোগাযোগ আছে এবং কোম্পানি লিখে না দিলে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে।’

মনিরুজ্জামান চিঠিতে আরও অভিযোগ করে লিখেছেন, ‘র‍্যাবের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নাজমুল হকের ফোন পেয়ে দেখা করতে যাই। পরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে শেয়ারের মালিকানা লিখে দেই।’

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৩ জুলাই তিনি পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম শাখায় যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-গণমাধ্যম) সোহেল রানা ৬ জুলাই প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিঠি এসেছে। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

এদিকে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের পাশাপাশি পাটের সরবরাহকারীরাও বিপদে পড়েছেন। ১৪ কোটি টাকার পাওনাদার ৪২ জন সরবরাহকারী পাওনা টাকার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন এবং নোমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

১ কোটি ৫৩ লাখ টাকার পাওনাদার সাহা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সুশীল কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নোমান চৌধুরী আমাদের পথে বসিয়েছেন।’ প্রায় একই কথা পিএন ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী প্রেমেন্দ্র সাহারও।

জটিলতার শুরু

২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাইড জুট মিলস এবং ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত গোল্ডেন জুট ইন্ডাস্ট্রিজ নামে মনিরুজ্জামানের আরও দুটি পাটকল রয়েছে। বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) ভাইস চেয়ারম্যান তিনি। তাঁর হাত ধরেই এ ব্যবসায়ে আসেন নোমান চৌধুরী।

জানা গেছে, দাহমাশীর ভেতরে জটিলতা শুরু হয় ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে। চেয়ারম্যান ও এমডির যৌথ স্বাক্ষরে ব্যাংক হিসাব পরিচালিত হলেও চেয়ারম্যান হঠাৎ কোনো চেকে স্বাক্ষর করছিলেন না। ফলে কাঁচা পাট সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধ করা যাচ্ছিল না। পাওনা টাকার দাবিতে নোমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মধুখালী থানায় মামলা করেছে আরিয়ান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মুরাদ পারভেজ।

র‍্যাবের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নাজমুল হক গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর হঠাৎ ফোন করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আইজিপিকে পাঠানো চিঠিতে এ কথা উল্লেখ করে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি ও আমার ছেলে র‍্যাব কার্যালয়ে যাই ২৩ ডিসেম্বর। নাজমুল হক জানান, নোমান চৌধুরীর লিখিত অভিযোগে আমাকে মাস্তান, সন্ত্রাসী, অর্থ আত্মসাৎকারী ও তাঁর জীবননাশের হুমকিদাতা হিসেবে উল্লেখ করেন।’

দেখা করার আগের দিন ২২ ডিসেম্বর গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন মনিরুজ্জামান। এতে বলা হয়, ‘এক বছর ধরেই নোমান চৌধুরী বলে আসছেন তাঁকে শেয়ার লিখে দিতে। প্রথম প্রথম রসিকতা মনে করলেও এখন বুঝতে পারছি, তা রসিকতা ছিল না।’

র‍্যাব কার্যালয়ে সমঝোতা

আইজিপির কাছে লেখা চিঠিতে মনিরুজ্জামান বলেন, গত ২৩ ডিসেম্বর এএসপি নাজমুল হক একপর্যায়ে বললেন সমস্যা সমাধান করে দুই দিনের মধ্যে তাঁকে জানাতে। ২৬ ডিসেম্বর আবার ডাকেন। মানসিক চাপ সইতে না পেরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নোমান চৌধুরীর হাতের লেখা সাদা কাগজে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন তিনি। পরদিন ২৭ ডিসেম্বর আবার কম্পোজ করা সমঝোতা স্মারক ও শেয়ার হস্তান্তরের ১১৭ ফরমে স্বাক্ষর করেন মনিরুজ্জামান।

এএসপি নাজমুল হক কেন এবং কীভাবে এ ব্যাপারে জড়িত হলেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত ২৮ জুন সোমবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা অভিযোগ ছিল বলে সমাধানের উদ্যোগ নিই। আর কিছু নয়।’ সমাধান করতে পেরেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরে শুনেছি মামলা, পাল্টা মামলা হয়েছে।’ কোনো অভিযোগ এলে ডেকে এনে সমাধান করা র‍্যাব কর্মকর্তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এটা করেছি।’

মাঝখানে ফরিদপুর জেলার সহকারী পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলামের কাছে নোমান চৌধুরী ও মনিরুজ্জামান আলাদা অভিযোগ করেন। তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা দুই পক্ষকে নোটিশ দিয়েছিলাম। কিন্তু মনিরুজ্জামান এলেও নোমান চৌধুরী আসেননি।’

গোপনে লেনদেন অন্য ব্যাংকে

দাহমাশী জুটের ব্যাংক হচ্ছে ওয়ান ব্যাংক। কিন্তু নোমান চৌধুরী গোপনে প্রিমিয়ার ব্যাংকের বনানী শাখায় একক স্বাক্ষরে দাহমাশী জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি হিসাব পরিচালনা করে আসছিলেন। ওই হিসাবে তিনি ২০১৭-২০২০ সময়ে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার লেনদেন করেন বলে প্রিমিয়ার ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

তবে নোমান চৌধুরী এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কোম্পানিকে জানিয়েই এসব লেনদেন করেছেন।

এদিকে মনিরুজ্জামানকে এমডি মেনে কোম্পানির দায়-দেনা নিয়মিত রাখার চিঠি দিয়ে আসছে ওয়ান ব্যাংক। আবার নোমান চৌধুরী দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ওয়ান ব্যাংক কোনো কিস্তি পায়নি। অথচ ২০২০ সালের ডিসেম্বরের আগপর্যন্ত তা নিয়মিত ছিল।

ওয়ান ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনজুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকের কাছে দাহমাশী জুট যেহেতু দায়বদ্ধ, ফলে ব্যাংকের অনাপত্তিপত্র ছাড়া মালিকানা হস্তান্তর সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমাদের কাছে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে আসেনি।’

ভুয়া নিরীক্ষার ভিত্তিতে মামলা

এরই মধ্যে ভুয়া একটি স্বতন্ত্র নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ১ মার্চ নোমান চৌধুরী প্রায় ৪৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মনিরুজ্জামানসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করেন। মোস্তফা কামাল অ্যান্ড কোম্পানি নামক একটি নিরীক্ষা ফার্ম এ প্রতিবেদন তৈরি করে। এজাহারে বলা হয়, চেয়ারম্যান ও অন্য পরিচালকদের অন্ধকারে রেখে সব আসামি মিলে শত শত কোটি টাকা অবৈধ লেনদেন করেন।

এ নিয়ে মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরে শুনলাম, পর্ষদের সিদ্ধান্তেই নিরীক্ষা ফার্মটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যাতে আমারও স্বাক্ষর দেওয়া আছে। জালিয়াতির একটা সীমা থাকা দরকার।’

মোস্তফা কামাল অ্যান্ড কোম্পানির অন্যতম অংশীদার মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দাহমাশী জুট ইন্ডাস্ট্রিজ নামক কোনো প্রতিষ্ঠানকে চিনিই না। ফলে ওই প্রতিষ্ঠান নিয়ে নিরীক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের নাম ও প্যাড ব্যবহার করে কেউ করে থাকতে পারে।’

এ বিষয়ে চেয়ারম্যান নোমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অন্যদের চাপে মোস্তফা কামাল অস্বীকার করে থাকতে পারেন। পুরো কোম্পানি দখলে নিতে র‍্যাব কার্যালয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাহায্য তো আমি চাইতেই পারি।’

আর মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি জানি, পাটের ব্যবসা কীভাবে করতে হয়। কিন্তু প্রতারণার শিকার হয়ে আজ বিপর্যস্ত। তবে ফরিদপুর পুলিশ ও র‍্যাবের শীর্ষ মহলের আশ্বাসে আমি ধৈর্য হারাইনি।’

সার্বিক বিষয় তুলে ধরে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি র‌্যাব কার্যালয়েই লেখা থাকে, জমিজমা, কোম্পানি ইত্যাদি কোনো বিষয় নিয়ে তারা কাজ করে না। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, এটা দেওয়ানি বিষয়। ফলে র‍্যাবের কোনো কার্যালয় বা কোনো কর্মকর্তা এ নিয়ে জড়িত হওয়ার কথা নয়। জড়িত হয়ে থাকলে এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ হয়েছে।’