ভারতের বন্দর ব্যবহার করতে চান ব্যবসায়ীরা
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড (নৌ প্রটোকল নামে পরিচিত) চুক্তির আওতায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হলদিয়া বন্দর ব্যবহার করতে চান এ দেশের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজজট যে হারে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে পণ্য রপ্তানিতে সময় আরও বেশি লাগবে। দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির হওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গের বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে।
এ বিষয়টি আলোচনায় এনেছে ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। সংগঠনটির সভাপতি আবুল কাসেম খান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা থেকে একটি কনটেইনার যদি সরাসরি ভারতে চলে যায়, তাহলে ২০০ ডলার খরচ বেশি পড়বে। তবে সময় সাশ্রয় হবে। তিনি জানান, এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারকে প্রস্তাব দেবে। অন্যদিকে বেসরকারি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড (এসএপিএল) বলছে, তারা এ বিষয়ে হলদিয়া বন্দরের সঙ্গে আলোচনা করেছে। হলদিয়া বন্দর এ বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে।
ভারতের বন্দর ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে সরকারের একটি বৈঠকেও। পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল নিয়ে গত ৭ আগস্ট একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি ছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তখনকার চেয়ারম্যান পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনালের ব্যবহার বাড়াতে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে একটি হলো হলদিয়া ও প্যারা দ্বীপ বন্দর ব্যবহার করে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ও জাহাজজট কমানো। বৈঠকের কার্যবিবরণীতে এ তথ্য পাওয়া যায়।
নৌ প্রটোকলের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত একে অপরের নৌপথ ব্যবহার করতে পারে। এর আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ট্রানজিট শুরু হয় ২০১৬ সালের জুন মাসে। ওই সময় আনুষ্ঠানিকভাবে মাশুলের বিনিময়ে ভারতীয় জাহাজ বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন ঢাকার পণ্যবাহী কনটেইনারগুলো প্রথমে চট্টগ্রামে বন্দরে যায়। সেখান থেকে ছোট জাহাজে উঠে যায় সিঙ্গাপুর অথবা শ্রীলঙ্কায়। সেখান থেকে বড় জাহাজ বা মাদার ভেসেলে উঠে যায় ইউরোপ বা অন্য কোনো দেশে। ভারতের বন্দর ব্যবহার করতে চাইলে ঢাকার আশপাশে থাকা পানগাঁও অথবা বেসরকারি রিভার টার্মিনাল ব্যবহার করে সরাসরি চলে যাবে পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়ায়। এর আগে রিভার টার্মিনালে শুল্কায়ন-সংক্রান্ত সব কাজ শেষ করা হবে।
শুল্কায়নের ব্যবস্থা আছে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের মুক্তারপুর রিভার টার্মিনালে। এটি চালু হয়েছে ২০১৫ সালে। সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের পরিচালক ও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনালের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) কামরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ঢাকার একটি কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিদেশে পাঠাতে সাত থেকে আট দিন লাগে। পশ্চিমবঙ্গের বন্দর ব্যবহার করলে তা পাঁচ দিনের মধ্যে পাঠানো যাবে।
এসএপিএল হলো দেশের বিদ্যুৎ খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপের একটি যৌথ বিনিয়োগের কোম্পানি। তারা এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের গার্ডেনরিচ টার্মিনাল ৩০ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছে। এ টার্মিনাল আগামী বছর চালু হবে।
হলদিয়া বন্দর পশ্চিমবঙ্গের হালদি ও হুগলি নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত। এটি পরিচালনা করে হলদিয়া বন্দর ট্রাস্ট। এ বন্দর চ্যানেলের গভীরতা প্রায় ৮ মিটার, যা চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে দেড় মিটার কম। দীর্ঘদিন বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কামরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘হলদিয়ার বন্দর চট্টগ্রামের মতোই। তবে এতে চট্টগ্রাম বন্দরের মতো চাপ নেই। তারা বসে আছে বিদেশি ব্যবহারকারীদের অপেক্ষায়। হলদিয়ার পাশাপাশি আমরা আরও কয়েকটি বন্দর ব্যবহারের কথা বলছি।’
দেশের পণ্যবাণিজ্যের প্রধান দুয়ার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০১৭ সালে প্রায় ২৫ লাখ ৬৭ হাজার কনটেইনার পরিবহন করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৩ শতাংশ। এর কারণ বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, অন্যদিকে আমদানিও বাড়ছে দ্রুত। চট্টগ্রাম বন্দর এ চাপ সামাল দিতে পারছে না। ২০১৭ সাল পুরোটাই ছিল জাহাজজটের বছর। এ সংকট কাটাতে সরকার বে টার্মিনাল, পতেঙ্গা টার্মিনাল ও লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে; যদিও একটিরও কাজ শুরু হয়নি। সব সমস্যার সমাধান হতো, যদি সরকার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে পারত। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা সময় বাঁচাতে ভারতের বন্দর ব্যবহার করতে চাইতেই পারেন। এতে দোষের কিছু নেই। তিনি বলেন, ‘আমাদের উচিত বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর কাজটি সময়মতো করছি কি না, তা নিশ্চিত করা।’
সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট মনে করে, শুধু পণ্য রপ্তানি নয়, ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রেও নৌপথ ব্যবহার করা যায়। ভারত থেকে নৌপথে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি বাড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত নৌসচিব মো. আবদুস সামাদ গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা এখনো তাঁদের কিছু বলেননি। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। এটা আরও বাড়ানোর কার্যক্রম চলছে। বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির জন্য তা যথেষ্ট। এখন পণ্য রপ্তানিতে দেরি হচ্ছে না।