ভারতের ট্রানজিটের প্রথম চালানে সরকার পাচ্ছে ৫৯ হাজার টাকা
চট্টগ্রাম বন্দর ও দেশের সড়কপথ ব্যবহার করে ভারতের ট্রানজিট পণ্যের প্রথম চার কনটেইনারের চালানে প্রায় ৫৮ হাজার ৯০০ টাকা বা ৬৯৪ ডলার আয় হচ্ছে সরকারের। চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম বন্দর—এই দুই সংস্থা সেবাবাবদ নানা খাতে এই ফি আদায় করেছে। এ চালানে টনপ্রতি সরকারের আয় হচ্ছে ৫৮৯ টাকা।
সরকারের আয়ের বাইরে বেসরকারি খাতে পণ্য পরিবহন সেবাবাবদ আয় হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। সমুদ্র ও সড়কপথে ট্রানজিট পণ্য পরিবহনকারী ম্যাঙ্গো লাইন লিমিটেড জানিয়েছে, কলকাতা থেকে সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে সড়কপথে আগরতলায় পৌঁছানো পর্যন্ত জাহাজ ও গাড়িভাড়া মিলে তারা পাচ্ছে ২ লাখ ৭২ হাজার টাকা। অবশ্য এই আয়ের বিপরীতে তাদের খরচও রয়েছে অনেক। সরকারি–বেসরকারি মিলে এই রুটে টনপ্রতি পণ্য পরিবহন খরচ দাঁড়াচ্ছে ৩ হাজার ৩০৮ টাকা।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বন্দরে যে মাশুল দিতে হচ্ছে, ট্রানজিট পণ্য পরিবহনেও একই মাশুল রয়েছে। তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ট্রানজিট পণ্যের জন্য আলাদা করে চারটি বাড়তি মাশুল আদায় করছে। এরপরও টনপ্রতি পণ্য পরিবহনের মাশুল হিসাব করা হলে তা খুব বেশি নয় বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। তবে পণ্য পরিবহন যদি বাড়ে, তাহলে মাশুল প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে কম হলেও আয় বাড়বে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, সরকারের আয়ের চেয়ে বড় কথা হলো ট্রানজিট পণ্য পরিবহন যদি বাড়ে, তাহলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে। সরকারের চেয়ে বেসরকারি খাতেই আয় বেশি হবে।
কলকাতা বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে সড়কপথ ব্যবহার করে এই চার কনটেইনার পণ্য নেওয়া হচ্ছে ভারতের উত্তর–পূর্বের রাজ্য ত্রিপুরা ও আসামে। গতকাল মঙ্গলবার ভারতের চালানটি ‘এমভি সেঁজুতি’ জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। চালানটি জাহাজ থেকে নামিয়ে প্রাইমমুভার ট্রেইলার গাড়িতে রাখা হয়েছে। কাস্টমস প্রক্রিয়া শেষে এটির ত্রিপুরার আগরতলার উদ্দেশেও রওনা হওয়ার কথা রয়েছে। চার কনটেইনারের দুটিতে মসুর ডাল এবং দুটিতে রয়েছে ইস্পাত পণ্য ‘টিএমটি বার’।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ট্রানজিট পণ্য পরিবহনের ঘটনা এবারই প্রথম। তবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ট্রানজিট পণ্য পরিবহন হয়েছে। যেমন, ২০১৬ সালের জুনে নৌ প্রটোকলের আওতায় কলকাতা থেকে নৌপথে আশুগঞ্জ হয়ে সড়কপথে ভারতের আগরতলায় পণ্য পরিবহন হয়। তখন টনপ্রতি ট্রানজিট মাশুল বাবদ ১৯২ টাকা, নিরাপত্তা ফি ৫০ টাকা, নৌবন্দরের ফি বাবদ সাড়ে ৩৪ টাকাসহ টনপ্রতি মোট ২৭৭ টাকা করে আদায় করা হয়েছিল। এবার সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের কারণে সরকারের আয় বেড়েছে। আবার সরকারি ফির কয়েকটি খাতও যুক্ত হয়েছে। অবশ্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রশাসনিক মাশুল পরীক্ষামূলক চালানে নেওয়া হচ্ছে না।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ট্রানজিট পণ্য পরিবহন শুরু হওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। তবে যে ধরনের সেবা দেওয়ার কথা, তা ভালোভাবে দেওয়া হলে এই পথটি নিয়মিত ট্রানজিট পথ হিসেবে ব্যবহার হবে। এতে উভয় পক্ষেরই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই পথে পণ্য পরিবহন কী পরিমাণ হবে, তা নির্ভর করছে এ মুহূর্তে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে পথটি কতটা আকর্ষণীয়, তার ওপর।
সরকারের আয়
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আদেশ অনুযায়ী, প্রতি চালানের প্রসেসিং মাশুল ৩০ টাকা, প্রতি টনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট মাশুল ২০ টাকা, নিরাপত্তা মাশুল ১০০ টাকা, এসকর্ট মাশুল ৫০ টাকা, কনটেইনার স্ক্যানিং মাশুল ২৫৪ টাকা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক মাশুল ১০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। চার কনটেইনারে ১০০ টন পণ্য রয়েছে। সেই হিসাবে কাস্টমস বা সরকার এ চালান থেকে রাজস্ব পাচ্ছে ৩৩০ ডলার বা ২৮ হাজার টাকা।
চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী এখন ছয় ধরনের মাশুল আদায় করা হয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ কনটেইনার জাহাজ থেকে নামানোসহ কয়েক খাতে মাশুল আদায় করেছে। বন্দর পর্ষদের সদস্য মো. জাফর আলম প্রথম আলোকে জানান, চার কনটেইনার পণ্য থেকে বন্দরের আয় হয়েছে ৩০ হাজার ৮৯৯ টাকা। মাশুল ও মূল্য সংযোজন কর বাবদ এই
আয় এসেছে।
বেসরকারি খাতে আয়
ট্রানজিট পণ্য পরিবহনে সরকারের চেয়ে বেসরকারি খাতে আয় হচ্ছে বেশি। যে জাহাজে করে চার কনটেইনার পণ্য আনা হয়েছে, তা বাংলাদেশি মালিকানাধীন জাহাজ। ফলে জাহাজ ভাড়া বাবদ অর্থ পাচ্ছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান। আবার জাহাজ থেকে নামানোর পর বাংলাদেশের কনটেইনার পরিবহনকারী গাড়িতে করে আগরতলায় নেওয়া হবে এ চারটি কনটেইনার। জাহাজ ও গাড়ি ভাড়া বাবদ মোট ২ লাখ ৭২ হাজার টাকা আয় হবে পণ্য পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাঙ্গো লাইন লিমিটেডের।
জানতে চাইলে ম্যাঙ্গো লাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইয়াকুব সুজন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক হিসাবে চার কনটেইনার পণ্যে প্রায় তিন লাখ টাকা আয় হতে পারে বলে হিসাব করেছি। তবে আনুষঙ্গিক খরচসহ তা আরও বাড়তে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর–পূর্ব রাজ্যে পণ্য পরিবহনের চুক্তি হয়েছিল ২০১৮ সালের অক্টোবরে দিল্লিতে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য সরবরাহবিষয়ক এ চুক্তিটি হয়। এক বছর পর ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ-সংক্রান্ত পরিচালন পদ্ধতির মান বা এসওপি সই হয়। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পরিবহনে সময় ও খরচ বেশি লাগে। এ জন্য প্রতিবেশী দেশটি চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পরিবহন করতে এই চুক্তি করে।