ব্যাংকের মুনাফার ওপর করপোরেট কর কমানোর কোনো অর্থনৈতিক যুক্তি নেই। এটি বড়লোকদের পক্ষে গেছে। ব্যাংকমালিকেরা ধনী লোক, তাঁদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আবার বড়লোকদের বিপক্ষে গেছে এমন উদ্যোগও আছে। যেমন দুটি গাড়ি থাকলে সারচার্জ দিতে হবে। কিন্তু এই সারচার্জ আদায়ের উদ্যোগ কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা এখন গাড়ি থাকে কোম্পানি, স্ত্রী-সন্তানদের নামে।
সার্বিকভাবে বাজেটটি গতানুগতিক হয়েছে। এই বাজেট থেকে বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হবে না, আবার বড় ধরনের উপকারও হবে না। বড় মাপের কোনো নতুন উদ্যোগ দেখা যায়নি। আবার দু-একটি ছাড়া বড় বিতর্কিত প্রস্তাব নেই। বাজেট গতানুগতিক বলা হলো এ কারণে যে বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে, আয় ও ব্যয়—উভয় লক্ষ্যই বড়। প্রশ্ন হলো, এই বাজেট অর্জিত হবে কি না।
রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নির্ভর করবে অর্থনীতির আকার কতটা বাড়বে। নমিনাল হিসাবে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১৩-১৪ শতাংশ হবে। রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি বড়জোর ১৬-১৭ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু রাজস্ব প্রবৃদ্ধি কিছুতেই ৩০-৩২ শতাংশ হবে না। রাজস্ব খাতে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে মোটাদাগে রাজস্ব আদায় কমতে পারে। ব্যাংক খাতে করপোরেট হার কমানোর ফলে এই খাতে বড় অঙ্কের কর কমবে। আবার তামাক খাতে কর বাড়িয়ে তা পোষানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে কতটা পোষানো সম্ভব হবে? আবার ভ্যাটেও রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্য অর্জন অনিশ্চিত। কেননা কিছু পণ্য ও সেবায় যেমন ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে, আবার কিছু পণ্যে কমানো হয়েছে। একই অবস্থা শুল্ক খাতেও। সামগ্রিকভাবে প্রকৃত রাজস্ব আদায় কতটা বাড়বে? কর নীতিতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে বাড়বে না, বরং কমতে পারে। আর ৩০ শতাংশের মতো রাজস্ব প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। এত বড় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে আগামী এক বছরের মধ্যে প্রশাসনিক দক্ষতা কতটা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
খরচের দিক চিন্তা করলে দেখা যায়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারছি না। বাস্তবায়ন সমস্যা নিয়ে বরাবরই আলোচনা করা হচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যা, ক্রয় পদ্ধতির দীর্ঘসূত্রতার মতো সমস্যা সমাধানের কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। আবার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাতা, প্রশিক্ষণ বাবদ বড় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই টাকা খরচ হবেই। এখন জনগণের সেবা কতটা বৃদ্ধি পায়, সেটাও দেখতে হবে।
সার্বিকভাবে দেখা যায়, খরচের লক্ষ্য অর্জিত হবে না, আবার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনও কঠিন। তাই সার্বিক ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে। তবে মূল সমস্যা হলো, ঘাটতি অর্থায়নের টাকা কীভাবে আসবে। ঘাটতি অর্থায়ন নিয়ে বাজেটে বলা হয়েছে, সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো হবে। কীভাবে কমানো হবে, তা পরিষ্কার করা হয়নি। সুদহার ও বিক্রির পদ্ধতির সংস্কার কীভাবে হবে, তা বলা হয়নি।
এবারের বাজেটে সেবা খাতের সংস্কারে কিছু কথা বলা হয়েছে। যেমন সড়ক নিরাপত্তা, শহর এলাকায় যানবাহন সমস্যা, পেনশন ইত্যাদি। বাজেটে এসব সম্পর্কে আইডিয়া (ধারণা) দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগের কথা বলা হয়নি। আবার সহজে ব্যবসা করার জন্য যুগোপযোগী কাস্টমস আইন, আয়কর আইন, ওয়ান-স্টপ সেবা আইন জরুরি। এই আইনগুলো করার উদ্যোগ নেওয়া হলে কবে নাগাদ চালু হবে, এই সম্পর্কে বাজেটে কোনো উল্লেখ নেই।
আবার উবার, পাঠাওয়ের মতো উঠতি ব্যবসায় করারোপ করা যুক্তিসংগত হয়নি। যানজটের তীব্র সংকটে এ ধরনের রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থা চালু হওয়ায় লোকজন উপকার পাচ্ছিল।
এই বাজেট থেকে সাধারণ মানুষের বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, বাজারমূল্য কেমন হবে। চালে ২৮ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছে। চালের দাম যাতে বেশি পড়ে না যায়, সে জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে হয়তো উৎপাদকের কিছুটা উপকার হবে। কিন্তু যাঁরা বাজার থেকে চাল কিনে খান, তাঁদের খুব বেশি সুবিধা হবে না। এই উদ্যোগের সঙ্গে ভোক্তা ও উৎপাদকের স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে।