বেশি দাম পেয়েও কমে বিক্রি

  • প্রতি ১০০ বস্তা ৮৭ ডলার দরে বিদেশি কোম্পানির কাছে বিক্রির চুক্তি।

  • ৯০ ডলার দরে নেওয়ার ক্রেতা আছে দেশেই।

  • জেনেশুনে লোকসান ৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।

ফাইল ছবি

বেশি দামে দেশি কোম্পানির কাছেই পাটের বস্তা বিক্রির সুযোগ আছে। কেনার জন্য বসেও আছে রপ্তানিকারক কোম্পানিগুলো, যারা বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনে (বিজেএমসি) নিবন্ধিত। কিন্তু বিজেএমসি দেশি রপ্তানিকারকদের জিজ্ঞাসা না করেই কম দামে ১ লাখ ৩৫ বেল বস্তা বিক্রি করে দেওয়ার চুক্তি করেছে বিতর্কিত এক বিদেশি কোম্পানির কাছে। দুবাইভিত্তিক এই কোম্পানির নাম তাইফ ইন্টারন্যাশনাল।

এতে প্রায় পৌনে ৮ কোটি টাকা কম পাবে সরকার। সুদানের ব্যবসায়িক গোষ্ঠী সিটিসি গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান তাইফ ইন্টারন্যাশনাল। এর চেয়ারম্যান ১৯৯১ সালে সুদানে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক অনারারি কনসাল জেনারেল আমিন আহমেদ আবদেল লতিফ। বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত থাকার অভিযোগে ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবদেল লতিফকে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিল।

গত ২৯ জুলাই বিক্রির সিদ্ধান্তের পরদিনই তাইফ ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি করেছে বিজেএমসি। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি ১০০ বস্তা ৮৭ ডলার দরে ১ লাখ ৩৫ বেল পাটের বস্তা কিনে নেবে তাইফ। এক বেল মানে হচ্ছে ৩০০ বস্তা ব্যাগ।

অতীতে চুক্তি করেও সিটিসি বিজেএমসির অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করেনি এবং পণ্যও নেয়নি। এমন অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও সংস্থাটি কেন এই কাজ করল, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেজিইএ)। বিজেএমসির চেয়ারম্যান আবদুর রউফ ২৯ জুলাই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেও ৩০ জুলাই কেন চুক্তি করতে বাধ্য হলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিজেজিইএর। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বিজেএমসির চেয়ারম্যান আবদুর রউফের সঙ্গে কথা বলতে ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর কার্যালয়ে গেলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে মোবাইল ফোনে জানান, এ বিষয়ে কথা বলতে তিনি রাজি নন।

বিজেএমসি রাতারাতি সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদেশি একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় তা বাতিলের দাবি উঠেছে।

এদিকে চুক্তিতে তাইফের পক্ষে সই করেছেন বিজেএমসির সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন খালেদ। অথচ চুক্তিপত্রে তাঁর কোনো পরিচয়ই দেওয়া নেই। ৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর পক্ষ থেকে হুমায়ুন খালেদের কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি কেন এবং কীভাবে তাইফের পক্ষে চুক্তিতে সই করলেন। জবাবে তিনি বলেন, মূল মালিকের পক্ষে এখানে এসে চুক্তি করা সম্ভব না হওয়ায় তাইফের পক্ষে তিনি সই করেন। হুমায়ুন খালেদ তাইফের কী—এমন প্রশ্নের জবাব দিতে চাননি তিনি।

সুদানে গত ১০ বছরে ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা মূল্যের পাটের বস্তা রপ্তানিকারক গোল্ডেন ফাইবার ট্রেড সেন্টার লিমিটেড প্রতি ১০০ বস্তা ৯০ ডলার দরে কেনার জন্য বিজেএমসিতে ঘুরছে। প্রতি ১০০ বস্তায় ৩ ডলার কমের কারণে বিজেএমসি কম পাবে ৯ লাখ ৩১৫ ডলার। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা দরে হিসাব করলে তা দাঁড়ায় ৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।

বিজেএমসির গোপনীয়তা

বিজেএমসির পর্ষদ বৈঠকের কাগজপত্রে দেখা যায়, সংস্থাটি তাইফকে কাজ দিতে গত ঈদুল আজহার ঠিক আগের সময়টিকে বেছে নেয়। ঈদ ছিল ১ আগস্ট শনিবার। বৈঠক হয় ২৯ জুলাই বুধবার আর তাইফের সঙ্গে চুক্তি হয় ৩০ জুলাই অর্থাৎ ঈদের আগের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার।

পর্ষদে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরেছে বিজেএমসি। পণ্যগুলো পুরোনো নয় এবং নষ্টও হয়ে যায়নি। তালিকাভুক্ত রপ্তানিকারকেরা বিজেএমসির ৮০ শতাংশ পণ্য রপ্তানি করে এলেও এখন তাদের না জানিয়েই বিদেশি কোম্পানিকে পণ্য দেওয়া হয়েছে কোন স্বার্থে, তা খতিয়ে দেখতে হবে
এম সাজ্জাদ হোসাইন, বিজেজিইএর চেয়ারম্যান

পর্ষদের বৈঠকে বলা হয়, তিন থেকে চার বছরের পুরোনো হওয়ায় এগুলোর গুণগত মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং একটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করলে বিক্রি আদেশ জারি করে বিজেএমসি, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি পণ্য উত্তোলনে ব্যর্থ হয়। পর্ষদে গোপন করা হলেও পণ্য না উত্তোলন করা ‘একটি প্রতিষ্ঠান’ হচ্ছে আমিন আহমেদ আবদেল লতিফেরই মালিকানাধীন দুবাইভিত্তিক আরেকটি প্রতিষ্ঠান, যার নাম সেনকম ইন্টারন্যাশনাল।

বিজেজিইএর চেয়ারম্যান এম সাজ্জাদ হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্ষদে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরেছে বিজেএমসি। পণ্যগুলো পুরোনো নয় এবং নষ্টও হয়ে যায়নি। তালিকাভুক্ত রপ্তানিকারকেরা বিজেএমসির ৮০ শতাংশ পণ্য রপ্তানি করে এলেও এখন তাদের না জানিয়েই বিদেশি কোম্পানিকে পণ্য দেওয়া হয়েছে কোন স্বার্থে, তা খতিয়ে দেখতে হবে।’

গত ১২ আগস্ট বস্ত্র ও পাটসচিব লোকমান হোসেন মিয়াকে পাঠানো চিঠিতে বিজেএমসি চেয়ারম্যান আবদুর রউফই জানিয়েছিলেন, ‘নির্ধারিত সময়ে অগ্রিম অর্থ জমা দিতে পারেনি তাইফ।’ মন্ত্রণালয় ১৮ আগস্ট জবাবে জানায়, বিজেএমসি নিজেই এ নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

তাইফের সঙ্গে চুক্তির শর্ত হচ্ছে তিন কর্মদিবসের মধ্যে পণ্যের মোট মূল্যের ১০ শতাংশ বিজেএমসির হিসাবে অগ্রিম জমা হওয়া, ১২০ দিনের মধ্যে সব পণ্য উত্তোলন করা এবং প্রতি লট জাহাজীকরণের আগে পণ্যমূল্যের ৯০ শতাংশ বিজেএমসির হিসাবে অগ্রিম পরিশোধ করা।

এ বিষয়ে গোল্ডেন ফাইবারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তিই যেখানে যথাযথ হয়নি, সেখানে মামলা হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। নিরপেক্ষ মতামত পেতে একই ধরনের ঘটনায় বিজেএমসি আগে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়েছিল। এবারও তাই নিতে পারে।

শর্ত পূরণও করেনি

বিজেএমসি থেকে পাটের বস্তা কিনতে হলে এত দিন স্থানীয় ক্রেতাদের ৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম দিতে হতো। বিজেএমসি গত জুলাইয়ে এই জামানত হঠাৎ ৭৫ শতাংশ করে দেয়। পরে তা ৫০ শতাংশ করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তাইফের সঙ্গে চুক্তি হয় ১০ শতাংশ অগ্রিমে। চুক্তি অনুযায়ী তিন কর্মদিবস অর্থাৎ ৫ আগস্টের অগ্রিম অর্থ জমা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।

তাইফের পক্ষে বিজেএমসির উদ্দেশে টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফারের (টিটি) মাধ্যমে গত ৬ আগস্ট ১০ শতাংশ অগ্রিম অর্থ ২৬ লাখ ১০ হাজার ৮৯৩ মার্কিন ডলার পাঠায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ফেয়ারএফএক্স পিএলসি, লন্ডন। ১৭ আগস্ট একই জায়গা থেকে পাঠানো হয় ২৩ লাখ ৪৮ হাজার ৯৮০ ডলার। দুই দফায় এ অর্থ পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জেপি মর্গান চেস ব্যাংক এন–এর মাধ্যমে। নিউইয়র্কে মাসখানেক মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নস্ট্র হিসাবে তা আটকে ছিল।

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউল হাসান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বিজেএমসির পরিচালক (বিপণন) মুহাম্মদ ওয়াহেদুজ্জামান একটি দল নিয়ে এসেছিলেন। ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে দলটি বলেছে, অর্থ ছাড় করতে কোনো সমস্যা নেই। এরপর এ অর্থ ৩ ও ৮ সেপ্টেম্বর ছাড় হয়েছে।

টিটিতে আসা অর্থ নিয়ে প্রশ্ন

বিজেএমসির পরিচালক মুহাম্মদ ওয়াহেদুজ্জামানকে গত ৪ মে বিজেএমসি থেকে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে বদলি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিজেএমসি কার্যালয়ে ৩ সেপ্টেম্বর গিয়ে দেখা যায়, তাঁর নামফলক ঝুলছে এবং তিনি অফিস করছেন। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে ওয়াহেদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না।

নিয়ম থাকলেও টিটির কপিতে অর্থ প্রেরণকারী হিসেবে তাইফ ইন্টারন্যাশনালের নাম-ঠিকানা নেই। কী ধরনের পণ্যের জন্য এ অর্থ তারও উল্লেখ নেই।

মার্কেন্টাইল ব্যাংককে ৩ সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে গোল্ডেন ফাইবার জানায়, টিটি দুটি নগদায়ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোলের (ওফাক) রোষানলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বস্ত্র ও পাটসচিব লোকমান হোসেন মিয়ার কাছে তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে ২ সেপ্টেম্বর জানতে চাইলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে বিজেএমসিই ভালো বলতে পারবে।’

জেপি মর্গান চেস ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মল্লিকা সেনাপতির কাছে ৬ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ই-মেইল বার্তায় জানতে চাওয়া হয় বিজেএমসির পণ্য যেহেতু সুদানে যাবে, এর বিপরীতে লেনদেন করলে জেপি মর্গান ওফাকের রোষানলে পড়বে কি না। ৮ সেপ্টেম্বর রাত ৮টায় মোবাইল ফোনে মল্লিকা সেনাপতি জানান, এ বিষয়ে কথা বলা থেকে তাঁরা বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

গোল্ডেন ফাইবারের এমডি মুশতাক হোসেন বলেন, সবাই চুপ থাকার মানেই হচ্ছে এখানে কিন্তু আছে।