বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সূচক উন্নতির জন্য কিছু সংস্কার করেছে সরকার

>
  • ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্সে উন্নতির জন্য কিছু সংস্কারকাজ শেষ করেছে সরকার
  • পরবর্তী র‍্যাঙ্কিং তৈরিতে চলতি মাসের মধ্যে শেষ করা সংস্কারগুলো বিবেচনায় নেবে বিশ্বব্যাংক।

বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা সূচক বা ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্সে উন্নতির জন্য কিছু সংস্কারকাজ শেষ করেছে সরকার। ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ছাড়পত্র পাওয়া, ভবন নির্মাণের অনুমতি, বিদ্যুৎসংযোগ দ্রুত দেওয়া, নমুনা খালাস সহজ করাসহ বেশ কিছু সংস্কারকাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে দাবি করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বলছে, আগামী অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হতে যাওয়া ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স-২০১৯-এ বাংলাদেশের অবস্থানের কিছুটা উন্নতি হতে পারে।

বর্তমানে ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৭৭তম। এ সূচকটি বিদেশি বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দুই অঙ্কে বা কমপক্ষে ৯৯তম অবস্থানে নিয়ে আসার লক্ষ্য ঠিক করেছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার জন্য কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেছে বিডা। সে অনুযায়ী আইন, বিধি ও প্রক্রিয়ায় সংস্কার চলছে।

বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, এ বছর ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সম্পাদিত সংস্কারকাজগুলো আগামী সূচকে বিবেচিত হবে। গত বছর এ সময়সীমা ছিল মে মাসের শেষ দিন পর্যন্ত। তা এক মাস এগিয়ে এনেছে বিশ্বব্যাংক। আগামী মাসে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের মানুষের ওপর জরিপ করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করবে।

মোটা দাগে মোট ১০টি ভিত্তির ওপরে বিশ্বব্যাংক ডুয়িং বিজনেসের ধাপ নির্ধারণ করে। এগুলো হলো ব্যবসা শুরুর অনুমোদন, ভবন নির্মাণের অনুমতি, বিদ্যুৎসংযোগ, সম্পত্তি নিবন্ধন, ঋণপ্রাপ্তি, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর প্রদান, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তির বাস্তবায়ন ও দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়া। বিডা বলছে, ডুয়িং বিজনেসের মূল ভিত্তিগুলোর মধ্যে কর দেওয়া, বিদ্যুৎসংযোগ পাওয়া, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা—এসব ক্ষেত্রে ভালো সংস্কার হয়েছে।

ডুয়িং বিজনেসে উন্নতি তদারকির জন্য গঠিত ন্যাশনাল কমিটি ফর মনিটরিং ইমপ্লিমেন্টেশন অব ডুয়িং বিজনেস রিফমর্সের (এনসিএমআইডি) প্রথম সভার কার্যবিবরণী, বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার দাবি করা সংস্কার কার্যক্রমের প্রতিবেদন ও বিডার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ উন্নতি করেছে বিদ্যুৎসংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুৎ বিভাগ ২৮ দিনের মধ্যে উচ্চক্ষমতার ও সাত দিনের মধ্যে আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎসংযোগ দেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি করে। বিদ্যুৎসংযোগের আবেদন কোন পর্যায়ে আছে, তা জানার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ফলে আগে শিল্পকারখানায় বিদ্যুৎ পেতে যেখানে ৪০৪ দিন লাগত, এখন সেখানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে আগে ২৭৮ দিন লাগত, এখন সেটা ৬০ দিনে মিলছে।

বিডা জানিয়েছে, কোম্পানি গঠনের শুরুতেই নামের ছাড়পত্র দেওয়া এবং নিবন্ধনপ্রক্রিয়া অনলাইন করা হয়েছে। বর্তমানে যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের দপ্তর (আরজেএসসি) থেকে আধা ঘণ্টার মধ্যেই নামের ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশে একক মালিকানার কোম্পানি গঠন সহজ করতে কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। শেয়ার হস্তান্তরের সময় যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের দপ্তরে হস্তান্তরকারীর সশরীরে উপস্থিতির প্রথা রহিত করা হয়েছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীর শেয়ার হস্তান্তরে ভোগান্তি দূর হয়েছে। কাগজবিহীন বাণিজ্যের আওতায় স্বল্পসংখ্যক নথি যুক্ত করে আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের কার্যক্রম শেষ করা হচ্ছে। এনবিআর ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় নমুনা সরবরাহ ও দ্রুততার সঙ্গে পণ্য খালাসের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া সাধারণ সভায় অনুমোদনের ৩০ দিনের মধ্যে শেয়ারমালিকদের লভ্যাংশ দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। অনলাইনে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) নিবন্ধন চালু হয়েছে। এনবিআরের হিসাবে, ইতিমধ্যে প্রায় ১ লাখ প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নিয়েছে। ভ্যাট ও টিআইএন নিবন্ধনের তথ্যভান্ডারে আন্তসংযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) ইতিমধ্যে চালু হয়েছে।

জানতে চাইলে বিডার পরিচালক তৌহিদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার আমরা কিছুটা উন্নতির আশা করতে পারি। কারণ যেসব সংস্কার হয়েছে, তার সুফল পাওয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের র‌্যাঙ্কিং অন্য দেশগুলো কী রকম করছে, তার ওপরও নির্ভর করে।’

অবশ্য সংস্কারের অনেক কাজই এখনো বাকি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিভাগ ও সংস্থার প্রধানদের নিয়ে গঠিত এনসিএমআইডির ৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রথম সভায় ভূমি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত ৮টি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত ৭টি, বিদ্যুৎ বিভাগ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ-সংক্রান্ত ২টি করে, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ও নৌ মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার বিভাগ, সুরক্ষা সেবা বিভাগ এবং এনবিআর-সংক্রান্ত ১টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়া বিডা সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংস্কার-সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে তাদের দিয়েছে। এ কর্মপরিকল্পনাও বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের বড় উন্নতি হবে বলে মনে করা হয়। অবশ্য এসব কর্মপরিকল্পনা সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ঠিক করেছে।

এ বছর বাংলাদেশের উন্নতি কতটুকু হতে পারে, জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ এবং বাণিজ্য ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বিভাগের প্রধান মাশরুর রিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এখন পর্যন্ত কী কী সংস্কার করেছে, তা জানানোর অনুরোধ জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সরকারের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানার পর তা বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস র‍্যাঙ্কিংয়ের দায়িত্বে থাকা দলকে জানানো হবে। তিনি বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে বলতে পারছি না যে, এ বছর বাংলাদেশের উন্নতি হবে, নাকি হবে না। কারণ অনেক সময় সংস্কার হলেও সেটা কাঙ্ক্ষিত মানে হয় না। আবার বেসরকারি খাত সংস্কারের সুফল পাচ্ছে কি না, তা অনুভব করতে পারে না।’ সবকিছু বিশ্বব্যাংকের এ-সংক্রান্ত দলের জরিপ ও মূল্যায়নের ওপর নির্ভর করে বলে উল্লেখ করেন তিনি।