বিশ্ব পেঁয়াজের বঙ্গদর্শন
ভারতীয় পেঁয়াজ বাংলাদেশের মানুষের রসুইঘর চেনে। মৌসুমের শেষ দিকে যখন দেশি পেঁয়াজ নাগাল ছাড়াতে শুরু করে, তখন তার কদর বাড়ানো ছাড়া সাধারণের উপায় থাকে না। আকারে বড়, কাটায় সুবিধা, দামও তুলনামূলক কম। তাই বছরজুড়ে খাবার হোটেল ও রেস্তোরাঁয় ভারতীয় পেঁয়াজের চাহিদাই বেশি থাকে।
এবার ভারত যেহেতু তার দেশের পেঁয়াজের সীমান্ত পেরোনো আটকে দিয়েছে, সেই সুযোগে বাংলাদেশের মানুষের রান্নাঘরে ঢুকে গেছে সুদূর চীন, মিসর ও তুরস্ক থেকে আগত পেঁয়াজ নামের অতিথিরা। পাশের দেশ মিয়ানমারের পেঁয়াজও এখন ঢাকার বাজার ঘুরছে দেশি পেঁয়াজের মতোই কদর নিয়ে। কারণ, সেটা দেখতে দেশি পেঁয়াজের কাছাকাছি, আকারও ছোট। কিছুদিন পাকিস্তানি পেঁয়াজও দেখা গেছে। যদিও এখন নেই।
মিসর থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব ৫ হাজার ৯৪২ কিলোমিটার। এটা গুগলের হিসাব। চীন এত বড় দেশ যে দূরত্ব কোন প্রদেশ থেকে মাপব, ঠিক বুঝতে পারছি না। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, মিসর ও চীন থেকে পেঁয়াজ জাহাজে আসতে ৪৫ দিনের মতো সময় লাগে। পেঁয়াজ আসে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কনটেইনারে। দেশে ঘাটতি এতটাই যে এবার উড়োজাহাজে উড়েও এল পেঁয়াজ।
ভারত গত ২৯ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে। নিজ দেশের বাজার সামাল দিতে দু-এক বছর পরপর ভারতকে রপ্তানি মূল্য বাড়িয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে নিষিদ্ধও করে তারা। যেমন ২০১০ ও ২০১১ সালে দেশটি পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছিল। এরপরে ২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে রপ্তানি মূল্য বাড়িয়ে পেঁয়াজের বিদেশ গমন ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল ভারত।
চীন-মিসরের পেঁয়াজ ঢাকায় একেবারেই নতুন, তা-ও বলা যাবে না। অতীতে ভারতের রপ্তানি বন্ধ বা মূল্য বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় কিছু কিছু পেঁয়াজ মিসর, তুরস্ক ও চীন থেকে বাংলাদেশে এসেছিল। অবশ্য তখন দেশি পেঁয়াজের মোটামুটি সরবরাহ ভালো থাকায় সাধারণ মানুষের তরকারিতে তারা মিশতে পারেনি, গন্তব্য সীমিত ছিল হোটেল-রেস্তোরাঁয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে শ্যামবাজারের নবীন ট্রেডার্সে ৫ টাকা কেজিতে চীনা পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখেছিলাম। এক ব্যবসায়ী বাজারে দাম বেশি দেখে আমদানি করেছিলেন। চালান আসতে একটু দেরি হয়ে যায়। তত দিনে দেশি ও ভারতীয় পেঁয়াজ মিলে বাজার নামিয়ে ফেলেছে। চীনা পেঁয়াজ তখন অচ্ছুত, পচনও ধরেছিল। তাই পাঁচ টাকা কেজিতে বেচে কোনোরকমে দোকান খালি করার উপায় খুঁজছিলেন নারায়ণ চন্দ্র সাহা।
এবার ঢাকার বাজারে দেশি পেঁয়াজের কেজি ২৫০ টাকা ছুঁয়েছে। হোটেল-রেস্তোরাঁর এ দরে পেঁয়াজ কিনে পোষাবে না। আর দেশবাসীর অনেকের তো এ দামে পেঁয়াজ কেনার সাধ্যই নেই। তাই ভরসা মিসর-চীনের পেঁয়াজ। সেটার দরও ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায় উঠেছিল। যদিও এখন কিছুটা কমে চীনা পেঁয়াজ প্রতি কেজি ১২০ টাকা ও মিসরের পেঁয়াজ ১৫০ টাকার আশপাশে বিক্রি হচ্ছে।
মিসরের যে পেঁয়াজ এবার আমদানি হয়েছে, তা আকারে বেশ বড়। রং অনেকটা লালচে। আকারে বড়গুলো বেছে নিলে চার-পাঁচটিতেও এক কেজি হতে পারে। ঝাঁজ তুলনামূলক কম।
ঢাকায় আসা চীনা পেঁয়াজের আকার আরও বড়। রং সোনালি। তবে খোসা ছাড়িয়ে নিলে সাদা। ঝাঁজ একেবারেই কম। সেদিন কারওয়ান বাজার থেকে বড় একটি পেঁয়াজ কিনে মেপে দেখা গেল ৫৫০ গ্রাম ওজন। রসিকতা করে এক সহকর্মী বললেন, এবার পেঁয়াজ শেয়ারিং অ্যাপ চালু করতে হবে, যাতে একটি কাটলে আশপাশের লোক ভাগ নিতে পারে।
তুরস্কের পেঁয়াজ চীনা পেঁয়াজের মতোই। আকার বড়, রং সোনালি, স্বাদে প্রায় ঝাঁজহীন। সে তুলনায় মিয়ানমারের পেঁয়াজ দেশি পেঁয়াজের কাছাকাছি। আকারে ছোট, তবে লম্বাটে গড়ন। ঝাঁজ অন্যদের তুলনায় বেশি। রং সোনালি, তবে চকচকে নয়।
পাকিস্তানি পেঁয়াজ অনেকটা গাঢ় গোলাপি। আকার দেশি পেঁয়াজের চেয়ে বড়, তবে মিসরীয় পেঁয়াজের চেয়ে ছোট। ঝাঁজ ভালো।
পেঁয়াজের এ পরিচয় ব্যবসায়ীদের দেওয়া। তাঁরা আরও জানান, ভারত থেকে দু–তিন ধরনের পেঁয়াজ বাংলাদেশে আসে। সেটা তাদের বিভিন্ন রাজ্যে উৎপাদিত। কোনোটা আকারে দেশি পেঁয়াজের চেয়ে কিছুটা ছোট, রং গাঢ় গোলাপি। কোনোটা আবার আকারে বেশ বড়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, পচা বাবদ ২৫ শতাংশের মতো বাদ দিয়ে দেশে বছরে প্রায় ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, গত মৌসুমে উৎপাদিত হয়েছে ২৪ লাখ ৩০ হাজার টন। আবার পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, উৎপাদিত হয়েছে ১৮ লাখ টন। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, আমদানি হয়েছে ১১ লাখ টনের মতো।
এসব গোলমেলে হিসাবের ধার না ধেরে ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত মৌসুমের শেষে বৃষ্টির কারণে পেঁয়াজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষক ঘরে রাখতে পারেননি। ফলে এখন সংকট। এতে ঘি ঢেলেছে ভারতের রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছর এ সময়ে আমদানি করা পেঁয়াজের সর্বনিম্ন দাম ছিল প্রতি কেজি ২০ টাকা, এখন ১২০ টাকা। দাম ৬০০ শতাংশ বেশি।
চড়া দামে পেঁয়াজ কিনে যাঁদের মাথা গরম, তাঁদের জন্য একটা পরামর্শ। কোনো পরিস্থিতিতে আপনার যখন কিছু করার থাকবে না, তখন অস্বস্তিকর বিষয়ের মধ্যেও স্বস্তি খুঁজুন। কীভাবে? পেঁয়াজের দাম বাড়ল বলেই কিন্তু আপনি মিসরীয় পেঁয়াজের স্বাদ পেলেন। নইলে মিসরে যেতে খরচ কত পড়ত, ধারণা আছে?
ঢাকা টু কায়রো উড়োজাহাজ ভাড়া ৬৭ হাজার ৯২৫ টাকা, শুধু যেতে। সে তুলনায় পেঁয়াজের দাম কি খুব বেশি?