বিনিয়োগ সক্ষমতা শুধু কম বেতনে!
>*ব্যবসার পরিবেশের প্রায় সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে বাংলাদেশ
*এগিয়ে শুধু শ্রমিক, প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকদের কম বেতন দেওয়ার দিক থেকে।
সমুদ্রবন্দরে পণ্যের একটি চালান আসার পর তা খালাসের প্রক্রিয়া শেষ করতে দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪ দশমিক ৪ দিন সময় লাগে। বাংলাদেশে এ প্রক্রিয়া শেষ করতে লাগে ১৫ দশমিক ৮ দিন। কোরিয়ায় একজন শ্রমিকের মাসিক মজুরি ২ হাজার ২০৮ ডলার। বাংলাদেশে ১০৯ ডলার।
এ চিত্র উঠে এসেছে বিভিন্ন দেশে কর্মরত জাপানি কোম্পানিগুলোর ব্যবসা পরিস্থিতি নিয়ে জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) এক জরিপে। জেট্রোর জরিপ ও অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ ব্যবসার পরিবেশের প্রায় সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে। এ দেশে শুধু শ্রমিক ও ব্যবস্থাপকদের পেছনে ব্যয় কম। ফলে উৎপাদন খরচ কম।
জেট্রোর জরিপে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৯টি দেশে উৎপাদনশীল খাতের শ্রমিক, প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপক এবং সেবা খাতের ব্যবস্থাপক ও কর্মীদের মাসিক ও বার্ষিক বেতনের চিত্র তুলে ধরা হয়। এটি শুধু জাপানি কোম্পানিগুলোর হিসাব।
জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, জরিপের আওতায় আসা ১৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে শ্রমিকের মজুরি সবচেয়ে কম। এ দেশে তিন বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন শ্রমিক মাসে মজুরি হিসেবে পান ১০৮ ডলার (প্রায় ৯ হাজার টাকা)। বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারের একজন শ্রমিক পান ১৬২ ডলার। এ মজুরি ভারতে ২৬৫ ডলার, পাকিস্তানে ১৮৭ ডলার এবং কম্বোডিয়ায় ২০১ ডলার।
শুধু শ্রমিকেরা নন, বেতন কম এ দেশের প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকদেরও। ১৯টি দেশের মধ্যে উৎপাদনশীল খাতে প্রকৌশলীদের মাসিক বেতন ২৮৭ ডলার (প্রায় ২৪ হাজার টাকা), যা ভারতে ৫৯১, পাকিস্তানে ৪৯২ ও মিয়ানমারে ৩৪৯ ডলার। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছাকাছি আছে কেবল শ্রীলঙ্কা। দেশটিতে প্রকৌশলীদের বেতন মাসে ২৯১ ডলার। উৎপাদনশীল ও সেবা খাতের ব্যবস্থাপকদের বেতনের দিক দিয়েও বাংলাদেশ তলানিতে রয়েছে। শুধু একটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে শ্রীলঙ্কা। সেটি হলো উৎপাদনশীল খাতের ব্যবস্থাপকদের বেতন। শ্রীলঙ্কায় ব্যবস্থাপকদের বেতন মাসে ৫২৬ ডলার, বাংলাদেশে তা ৭৯৩ ডলার।
বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা বা ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৭৬তম। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আফগানিস্তানও। বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিকস পারফরম্যান্স ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬০টি দেশের মধ্যে ১০০তম।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সচরাচর যে মানদণ্ডে একজন বিনিয়োগকারী একটি দেশে আসেন, তার অধিকাংশই বাংলাদেশে অনুপস্থিত। এখানে হয়তো কর্মী পাওয়া খুব সহজ। এর কারণ প্রচুর মানুষ শ্রমবাজারে রয়েছে। তিনি বলেন, জাপানি কোম্পানিগুলো যেহেতু মানসম্পন্ন ব্যবস্থাপক পাচ্ছে না, প্রচুর আধা দক্ষ বা অদক্ষ ব্যবস্থাপক চাকরির আবেদন করছে, তখন কম বেতনে নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়।
অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের ব্যবস্থাপকদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ থাকে না উল্লেখ করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশি পোশাক খাতের ব্যবস্থাপকদের বক্তব্য অনুযায়ী তাঁদের কাজের মান বিদেশিদের সমান। তবে তাঁদের সার্বিক ধারণা, উপস্থাপনার দক্ষতা ও ইংরেজি জ্ঞান কম।
বন্দরে সময় বেশি লাগে বাংলাদেশে
জেট্রোর জরিপে জাপানি কোম্পানিগুলোকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ব্যবসা সম্প্রসারণের কারণ কী কী। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থানে আছে সহজে শ্রমিক প্রাপ্যতার দিক থেকে। এ ছাড়া উচ্চ প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধি, সরবরাহ ও উৎপাদন ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা ও উদার নীতির ক্ষেত্রে জাপানিদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। জাপানিদের চোখে বাংলাদেশে প্রধান পাঁচটি সমস্যা হলো পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ কঠিন, কর্মীর নিম্নমান, কাস্টমসে পণ্য খালাসে বিলম্ব, জটিলতা ও মজুরি বৃদ্ধি।
জেট্রোর জরিপ অনুযায়ী, ১৯টি দেশের মধ্যে সমুদ্রবন্দরে সময় বেশি লাগে পাকিস্তানে। আমদানি পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া শেষ করতে পাকিস্তানে ১৬ দশমিক ৬, বাংলাদেশে ১৫ দশমিক ৮, মিয়ানমারে ১৩ দশমিক ৩ ও ভারতে ১২ দিন লাগে। একইভাবে বিমানবন্দরে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে বাংলাদেশে।
উৎপাদন খরচ অর্ধেক
জাপানের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের উৎপাদন খরচের একটি চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে জেট্রোর জরিপে। এতে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। জাপানে যে পণ্যটি উৎপাদন করতে ১০০ টাকা খরচ হবে, সেটি বাংলাদেশে উৎপাদনে খরচ হবে ৫১ টাকা। লাওসে খরচ হবে ৫০ টাকার কিছু বেশি। একই পণ্য উৎপাদনে শ্রীলঙ্কায় ৬১, কম্বোডিয়ায় ৬৩, ভিয়েতনামে ৭৩, মিয়ানমানে ৭৬, ভারতে ৭৭ ও পাকিস্তানে ৮২ টাকার মতো খরচ হয়। জরিপ অনুযায়ী, এ দেশে কর্মরত ৭৩ শতাংশ জাপানি কোম্পানি বলেছে, বাংলাদেশে তারা ব্যবসা বাড়াবে। এ হার অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি।
জেট্রো ১৯৮৭ সাল থেকে এ ধরনের জরিপ করে। এবারেরটি তাদের ৩২তম জরিপ। জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে গত ৯ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত।