বিদেশে বসেই দেশি আমের স্বাদ
বিশ্বে আম উৎপাদনে ভারত শীর্ষে। বাংলাদেশও শীর্ষ দশে রয়েছে। তবে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের আম রপ্তানি অনেক বেশি। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভারত প্রায় ৫০ হাজার টন আম রপ্তানি করে, আয় হয় প্রায় ৪০০ কোটি রুপি। আগের অর্থবছরে ভারত সাড়ে ৪৬ হাজার টন আম রপ্তানি করে ৪০৬ কোটি রুপি আয় করে।
মৌসুমের মাঝামাঝিতে এখন বাজার ভরা আমে। ফলের দোকানে অন্য ফলকে মোটামুটি বিদায় করে দিয়েছে আম। দেশের মানুষ নিজের সাধ্য অনুযায়ী কেউ কেজি দরে, কেউ ঝুড়ি ভরে আম কিনছেন। দেশের মানুষ না হয় খাচ্ছে, বিদেশবিভূঁইয়ে থাকা প্রবাসীরা কি কেবল দেশি আমের তরতাজা ছবি বা ভিডিও দেখে হা–হুতাশ করছেন।
শুনলে কিছুটা আশ্চর্য হতে পারেন, ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি ও সৌদি আরবপ্রবাসীরা দেশি আমের ঘ্রাণ নিয়েছেন। চেখেও দেখেছেন।
বেশ কয়েক বছর ধরেই ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আম রপ্তানি হচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা এই আম আমদানি করেন। উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও সাতক্ষীরার চুক্তিভিত্তিক চাষিদের কাছ থেকে আম সংগ্রহ করে মোড়কজাত করে উড়োজাহাজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠান রপ্তানিকারকেরা।
গতবার করোনার কারণে আম রপ্তানি কমে ২৭৮ টন হয়েছিল। চলতি বছর ৯০০ টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন রপ্তানিকারকেরা।
মূলত সারা বছর সবজি ও ফলমূল রপ্তানিকারকদের মাধ্যমেই আম যাচ্ছে বিদেশে।
বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফভিএপিইএ) জানায়, ২০১৭–১৮ অর্থবছরে ২৩১ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হয়। পরের বছর সেটি বেড়ে ৩০৮ টনে দাঁড়ায়। গতবার করোনার কারণে আম রপ্তানি কমে ২৭৮ টন হয়েছিল। চলতি বছর ৯০০ টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন রপ্তানিকারকেরা।
এনএইচই করপোরেশন নামের এক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান গত ২২ মে ইতালিতে ১ হাজার ৮৩৫ কেজি আম রপ্তানি করে। চলতি মৌসুমে তারা ১০০ টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত আছেন বেশ কয়েকজন কৃষক।
এনএইচই করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী নাজমুল হায়দার ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে যাত্রীবাহী ফ্লাইটের সংখ্যা খুবই কম। কাতার ও এমিরেটসের কার্গো চললেও তাতে আম পাঠানোর খরচ তুলনামূলক বেশি। তারপরও প্রবাসীরা দেশের আম খেতে ভালোবাসেন। সে কারণেই খরচ বেশি হওয়ার পরও যাচ্ছে। আশা করছি, অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় এবার বেশি পরিমাণে আম রপ্তানি করা যাবে।’
বিশ্বে আম উৎপাদনে ভারত শীর্ষে। বাংলাদেশও শীর্ষ দশে রয়েছে। তবে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের আম রপ্তানি অনেক বেশি। গত ২০১৯–২০ অর্থবছরে ভারত প্রায় ৫০ হাজার টন আম রপ্তানি করে, আয় হয় প্রায় ৪০০ কোটি রুপি। আগের অর্থবছরে ভারত সাড়ে ৪৬ হাজার টন আম রপ্তানি করে ৪০৬ কোটি রুপি আয় করে।
এদিকে রপ্তানির পাশাপাশি স্বাস্থ্যসচেতন ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে ফ্রুট ব্যাগিং (বিশেষ ধরনের কাগজের ব্যাগ দিয়ে আবৃত করা) পদ্ধতিতে আম উৎপাদন জনপ্রিয় হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত আম রাসায়নিক বালাইনাশকমুক্ত হয়ে থাকে। যদিও আমপ্রতি পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টাকা খরচ হয়। চীন থেকে এই ফ্রুট ব্যাগ আমদানি করা হয়।
আমচাষিরা জানান, ৪০ থেকে ৫৫ দিন বয়সের আমে ব্যাগিং করার উপযুক্ত সময়। ব্যাগিং করার আগে আমে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রে করে শুকিয়ে নিতে হয়। রঙিন আমের জন্য সাদা ব্যাগ ও সবুজ আমের জন্য দুই আস্তরের বাদামি ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এসব ব্যাগ বৃষ্টি ও ঝড়ে ছিঁড়ে যায় না। এ ব্যাগ ব্যবহারে আম আঘাত, পাখির আক্রমণ, প্রখর সূর্যালোক, রোগ ও পোকামাকড় থেকে রক্ষা পায়।
চলতি মৌসুমে রাজশাহীর বাঘায় প্রায় তিন কোটি আম ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদন হচ্ছে। গতবার হয়েছিল এক কোটি আম। ৭০০–৮০০ বিঘা জমিতে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে ফজলি ও ল্যাংড়া আম উৎপাদন করছেন এই এলাকার ২০ জন চাষি। ২০১৪ সাল থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহায়তায় চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ করছেন তাঁরা।
বাঘার কন্ট্রাক্ট ফার্মিং কৃষক সমিতির সভাপতি শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানির জন্যই আমরা মূলত ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম উৎপাদন করছি। তবে রপ্তানি কম হওয়ায় দেশের বাজারে বিক্রি হয়। তাতে সাধারণ আমের চেয়ে দাম কেজিতে ১০–২০ টাকা বেশি পাওয়া যায়।’
দেশে অনেক জাতের আম উৎপাদন হলেও হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি ও ফজলি আম প্রবাসীদের বেশি পছন্দ। চলতি মৌসুমে প্রথম সাতক্ষীরা থেকে গোপালভোগ আম রপ্তানি হয়েছে কুয়েতে। তারপর ইতালি, যুক্তরাজ্য ও কানাডা গেছে।
কয়েকজন রপ্তানিকারকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে অনেক জাতের আম উৎপাদন হলেও হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি ও ফজলি আম প্রবাসীদের বেশি পছন্দ। চলতি মৌসুমে প্রথম সাতক্ষীরা থেকে গোপালভোগ আম রপ্তানি হয়েছে কুয়েতে। তারপর ইতালি, যুক্তরাজ্য ও কানাডা গেছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাবে বাংলাদেশের আম।
দীর্ঘদিন ধরে সবজি রপ্তানি ও ফল রপ্তানি করছে আঁখি এন্টারপ্রাইজ। গত ২৩ মে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ১ হাজার ৫৮ কেজি আম পাঠিয়েছে তারা। সেগুলো ছিল সাতক্ষীরার গোপালভোগ। সিলেটের এক প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী এসব আম আমদানি করেছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে আঁখি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। তারপরও আশা করছি, চলতি মৌসুমে অনেক আম রপ্তানি করা যাবে।’
করোনার কারণে যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের সংখ্যা একেবারেই কম। ফলে কার্গো বা পণ্যবাহী উড়োজাহাজে আম পাঠাতে হচ্ছে। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজে পাঠালে প্রতি কেজি আমে ১০–১৫ টাকা খরচ পড়ত। কিন্তু কার্গোতে খরচ ১০০ টাকা।
আম রপ্তানি কী দামে হচ্ছে, সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খুলতে চান না ব্যবসায়ীরা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন রপ্তানিকারক জানান, মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে সম্প্রতি এক টন আম উড়োজাহাজ ভাড়াসহ প্রায় ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ ডলারে রপ্তানি হয়েছে। তাতে প্রতি কেজির দাম পড়েছে আড়াই ডলার বা তার একটু বেশি। দেশীয় মুদ্রায় ২০০ টাকার বেশি।
আম রপ্তানি নিয়ে জানতে চাইলে বিএফভিএপিইএ সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের সংখ্যা একেবারেই কম। ফলে কার্গো বা পণ্যবাহী উড়োজাহাজে আম পাঠাতে হচ্ছে। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজে পাঠালে প্রতি কেজি আমে ১০–১৫ টাকা খরচ পড়ত। কিন্তু কার্গোতে খরচ ১০০ টাকা। তা ছাড়া অন্য দেশের মতো বাংলাদেশে আম প্রক্রিয়াজাত প্রক্রিয়া আধুনিক নয়। উন্নতমানের রাসায়নিকও আমাদের কাছে নেই। প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে দীর্ঘদিন সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে সমুদ্রগামী জাহাজে আম পাঠানো যেত। সেটির খরচ হতো আকাশপথের চেয়ে অনেক কম। আর খরচ কম হলে আম রপ্তানি আরও বেশি হতো।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ মনসুর বলেন, ‘ভারতে মোটামুটি সারা বছর আম উৎপাদন হয়। আর আমাদের দেশে মাত্র দুই মাসের মতো। বারো মাস ফলন দেয়, এমন আম চাষ শুরু হয়েছে। আশা করি ভবিষ্যতে আমরা সারা বছর আম রপ্তানি করতে পারব।’