টাকা পাচার নিয়ে ইদানীং আলোচনা বেড়েছে। কেউ কেউ একে মৌসুমি আলোচনা বলতে পারেন। টাকা পাচার নিয়ে আলোচনার মৌসুম মূলত দুটি। প্রতিবছরের মার্চে নিউইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচার নিয়ে একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তখন একবার টাকা পাচার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সরকারের পক্ষ থেকেও কিছু গৎবাঁধা এবং মুখস্থ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
এরপরের আলোচনাটি হয় জুন মাসে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) এ সময় ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড’ নামের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে কোন দেশের নাগরিকদের কত অর্থ সুইস ব্যাংকগুলোতে আছে, তার তথ্য প্রকাশ করা হয়। সেই প্রতিবেদনে অবশ্য অর্থের পরিমাণ থাকে, নাগরিকদের নাম থাকে না।
এখন অবশ্য টাকা পাচারের আলোচনার মৌসুম একটা হয়ে গেছে। কারণ, করোনাভাইরাসের কারণে জিএফআই পরপর দুবার তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ফলে মার্চের মৌসুমটি বৃথাই গেছে। জুন মৌসুমের আলোচনা অবশ্য সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই শুরু হয়ে গেছে। এর কৃতিত্ব কয়েকজন সাংসদের। তাঁরা অর্থ পাচার নিয়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। বাজেট অধিবেশনে কয়েকজন সাংসদের এসব আলোচনার জবাবও দিতে হয় অর্থমন্ত্রীকে। বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী নিজেই যখন টাকা পাচারকারীদের নাম জানতে চান, তখন পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের অঙ্গীকার নিয়েই আসলে প্রশ্ন উঠে যায়।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) গত বৃহস্পতিবার ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০২০’ নামের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সাল শেষে দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ৫৬ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ২০৩কোটি টাকা (১ সুইস ফ্রাঁ = ৯২.২৮ টাকা)। আগের অর্থবছরে যা ছিল ৬০ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ। অর্থাৎ এক বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ৬ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। এই নিয়ে পরপর তিন বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ কমল।
সুইস ব্যাংকে রাখা সব অর্থই যে অবৈধ, তা বলা যাবে না। দেখা যায় বাংলাদেশ থেকে নানাভাবে অবৈধ উপায়ে পাচার হওয়া অর্থ যেমন সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা হয়, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও দেশটিতে অর্থ জমা রাখেন। সুতরাং এখানে বৈধ-অবৈধ সব অর্থই রয়েছে। তবে গ্রাহকদের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে বিশ্বজুড়ে সুইস ব্যাংক ব্যবস্থার সুনাম আছে। এ জন্য দেশটি রীতিমতো আইন করেছে। সুতরাং এখানে গোপন অর্থ রাখার সংখ্যাই বেশি।
পরপর তিন বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ রাখার পরিমাণ কমার তথ্য থেকে কেউ যদি মনে করেন যে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার কমেছে, তা ঠিক হবে না। এখন সুইস ব্যাংকগুলোর আর সেই রমরমা ব্যবসা নেই। ১৯৩৪ সালে সুইজারল্যান্ড সরকারের করা ‘সুইস ব্যাংকিং অ্যাক্ট’ অনুযায়ী কোনো গ্রাহকের তথ্য সুইস ব্যাংকগুলো প্রকাশ করতে পারত না ঠিকই, তবে ২০১০ সালে ওবামা সরকারের করা ‘ফরেন অ্যাকাউন্ট ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স অ্যাক্ট’ নামের আইনটি করার পর অনেক কিছু পাল্টে গেছে। এই আইন অনুযায়ী, এখন সুইস ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকের বেশ কিছু তথ্য দিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দেখাদেখি ইউরোপের বেশ কিছু দেশও এখন তথ্য পেতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। এমনকি পাশের দেশ ভারতও স্বয়ংক্রিয় তথ্য বিনিময়কাঠামো নামের একটি চুক্তি করেছে। ফলে আগের মতো সুইস ব্যাংকগুলো কঠোর গোপনীয় নীতি মেনে চলতে পারছে না। গোপনীয়তার নীতি থেকে সরে আসার জন্য সুইস ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী এখন পাচার করা অর্থ রাখারও নতুন নতুন জায়গা বা উৎস তৈরি হয়েছে। কেইম্যান আইল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর বা হংকংকের মতো দেশে কোম্পানি খুলে অর্থ রাখার নানা পথ রয়েছে। ফলে এখন আর অর্থ লুকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সুইস ব্যাংকের একক আধিপত্য নেই।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন আইসিআইজি আগে পানামা পেপারস বা প্যারাডাইস পেপারস নামে যেসব নথি প্রকাশ করেছে, সেখানে অর্ধশতাধিক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠানের নাম আছে। এরা সবাই বেনামে কোম্পানি খুলে অর্থ পাচার করেছে। আবার সিঙ্গাপুর, দুবাই, হংকং, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অনেক বড় বড় ব্যবসাও রয়েছে। মালয়েশিয়া বা কানাডায় বাড়ি কেনার অসংখ্য তথ্য বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এসব তথ্য সবারই জানা। সুতরাং সুইস ব্যাংক এখন অর্থ পাচারের একমাত্র গন্তব্য নয়।
যেমন সুইস ব্যাংকে ৫ হাজার কোটি টাকা গচ্ছিত রাখা আছে বলে তথ্য বেরিয়েছে। অথচ জিএফআইয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। বর্তমান বাজারদরে তা ৬৪ হাজার কোটি টাকা। জিএফআই মূলত অর্থ পাচারের তথ্য বের করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিসংখ্যান থেকে। হুন্ডি বা সরাসরি অর্থ পাচারের কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয় আসলে ৬৪ হাজার কোটি টাকার অনেক বেশি। এই ৬৪ হাজার কোটি টাকা দিয়ে বছরে দুটি করে পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব।
এ বছর যেমন জাতীয় সংসদে অর্থ পাচার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ২০১৪ সালের এই জুন মাসেই একইভাবে সুইস ব্যাংকে রাখা অর্থ নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সুইস ব্যাংকে কে কত টাকা পাচার করেছেন, তার তালিকা হচ্ছে। দেশের টাকা আমরা দেশে ফিরিয়ে আনবই।’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরে কিছু নড়াচড়াও শুরু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে সুইজারল্যান্ডের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) কাছে সে দেশের ব্যাংকগুলোতে রাখা বাংলাদেশিদের অর্থের তথ্য চাওয়ার পাশাপাশি সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করার জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এত বছরেও এর কোনো অগ্রগতি নেই। কোনো কার্যকর উদ্যোগই আসলে সরকারের নেই।
সবশেষে বলা যায়, প্রশ্নটা আসলে আন্তরিকতা, অঙ্গীকার ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার। সরকার আসলেই টাকা পাচারকারীদের ধরতে চায় কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই বলেই চলতি জুন মাস চলে গেলেই টাকা পাচারের আলোচনাও এবারের মতো শেষ হয়ে যাবে। আলোচনার একপর্যায়ে সরকার বরাবরের মতো কিছু প্রতিশ্রুতিও দেবে, যা আগের বছরগুলোতেও দেওয়া হয়েছিল। অর্থ পাচারকারীও জানেন, এসব কথা কেবল মুখের কথাই। ফলে কর ফাঁকি আগের মতোই চলতে থাকবে। বাড়বে কালোটাকা। ব্যাংকের দেওয়া ঋণ ফেরত আসবে না। মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা থেকে আয় বাড়বে। সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ-দুর্নীতি চালিয়েই যাবেন। আর এসব অর্থ পাচার হয়ে যাবে অন্য দেশে, এর কিছু অংশ যাবে সুইস ব্যাংকে। সুতরাং সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ কমেছে—এ তথ্যে স্বস্তি পাওয়া কিংবা খুশি হওয়ার মতো কিছু নেই।