বস্ত্র ও পোশাকশিল্প বিপাকে
জে কে গ্রুপের তিনটি কারখানা—জে কে স্পিনিং মিলস, জে কে কটন মিলস এবং জে কে সিনথেটিকের অবস্থান গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কড্ডা এলাকায়। কারখানা তিনটি গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে করপোরেশনকে ১০ লাখ টাকা হোল্ডিং ট্যাক্স দিয়েছে। তবে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে করপোরেশন সেই কর বৃদ্ধি করে ৪৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে।
এক বছরের ব্যবধানে হোল্ডিং ট্যাক্স ৩৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকা বা ৩৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি করায় আপত্তি জানিয়ে সিটি করপোরেশনে দুই দফা আবেদন করেছে জে কে গ্রুপ। তবে এক মাসেও বিষয়টি মীমাংসা হয়নি। ফলে কারখানা তিনটি ট্রেড লাইসেন্সও নবায়ন করতে পারছে না।
জে কে গ্রুপের উপমহাব্যবস্থাপক ইকবাল আকরাম গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো কারণ ছাড়াই হোল্ডিং ট্যাক্স পাঁচ গুণ বাড়িয়েছে করপোরেশন। সেটি নিয়ে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছি। বিষয়টি সমাধান না হওয়ায় ট্রেড লাইসেন্সও নবায়ন হচ্ছে না। সে জন্য আমাদের আমদানি প্রাপ্যতা (ইউডি), ঋণপত্র খেলাসহ নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।’
এই গ্রুপটির মতো অনেক বস্ত্র ও পোশাক কারখানার হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি করেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন। ফলে বাড়তি করের চাপে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। তাঁদের অভিযোগ, হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ না করলে কারখানার ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করছে না করপোরেশন।
অবশ্য সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা নতুন করে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ায়নি। আগে কারখানার কর ঠিকমতো আদায় হতো না। অনেকে আবার বিভিন্ন পন্থায় কর কম দিতেন। তা ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানের স্থাপনার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকলে আপিল করার সুযোগ আছে। কারখানার ক্ষেত্রে হোল্ডিং ট্যাক্স প্রতি বর্গফুটে ১৭ টাকা। তার মধ্যে কর ৭ টাকা, সড়কের বাতি ৩ টাকা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য ৭ টাকা। বাসার ক্ষেত্রে হোল্ডিং ট্যাক্স প্রতি বর্গফুটে ১০ টাকা।
দেশের অন্য যেকোনো জেলার চেয়ে গাজীপুরে পোশাক কারখানা ও বস্ত্রকলের সংখ্যা বেশি। শিল্প পুলিশের হিসাবে, গাজীপুরে বর্তমানে ১ হাজার ২৪২টি কারখানা রয়েছে। বিজিএমইএর হিসাবে, গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে আছে ৬৭১টি কারখানা। প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার ৮০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে এসব কারখানা।
বেশ কিছু কারখানা বাড়তি হোল্ডিং ট্যাক্স আরোপের বিষয়টি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএকে জানিয়েছে। এ নিয়ে গত ২৯ জুলাই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে বৈঠক করে বিজিএমইএর পরিচালনা পর্ষদ। সেই বৈঠকে সংগঠনের নেতারা অভিযোগ করেন, ২০০ থেকে ৬০০ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে। কর নির্ধারণের নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেওয়া হয় না। আবার হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ করা না হলে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করা যায় না, যা ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পরিপন্থী। ১৭ শতাংশ হারে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করায় পোশাক কারখানাকে আর্থিকভাবে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। বিজিএমইএ নেতারা আগামী পাঁচ বছরের জন্য হোল্ডিং ট্যাক্স ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা ও তা কিস্তিতে পরিশোধ, হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের সঙ্গে ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের বিষয়টি মিলিয়ে না ফেলা, হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের নোটিশের সঙ্গে নিরীক্ষা প্রতিবেদন সংযুক্ত করার দাবি জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়রের সঙ্গে বৈঠকের পর কেস-টু-কেস ভিত্তিতে বেশ কিছু কারখানার সমস্যার সমাধান হয়েছে। তবে এটি সাময়িক, স্থায়ী সমাধান নয়। সে জন্য আমরা আবারও মেয়রের সঙ্গে বৈঠকে বসব।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান বাস্তবতায় কারখানাগুলোর জন্য হোল্ডিং ট্যাক্সের পরিমাণ বেশি।’
অন্যদিকে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাজীপুরে রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো নয়। ভবনের নকশা দিলে পাস হয় না। প্রকৌশলী না থাকার অজুহাত দেয়। তাহলে আমরা কেন এত কর দেব?’ তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে উঠেছে। তারা কারও কথাই শুনছে না। কোনো কারণ ছাড়াই হোল্ডিং ট্যাক্স কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।’
জানতে চাইলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও উন্নয়নকাজ করের টাকা দিয়েই করতে হয়। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান যদি কর না দেয়, তাহলে সাধারণ মানুষ কেন দেবে? তবে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি রুগ্ণ হয়, অবশ্যই তাদের ছাড় দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন করে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হয়নি। হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ না করার কারণে কারও ট্রেড লাইসেন্স আটকে রাখা হয়নি।’