বন্ধকির নীরব ব্যবসা চুপসে গেল করোনায়
সাধারণত অর্থসংকটে বা বিপদে পড়া গ্রাহকের কাছ থেকে স্বর্ণালংকার বন্ধক রেখে তার বিপরীতে চড়া সুদে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ঋণ দেওয়া, আবার সুদসহ ঋণ পরিশোধের পর ওই গ্রাহকের স্বর্ণালংকার ফেরত দেওয়া, এরই নাম বন্ধকি ব্যবসা। দেশের বিভিন্ন স্থানেই চুপচাপ ও নীরবে এ ব্যবসা চলে। এ ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র হলো রাজধানীর তাঁতীবাজার, যেখানে কয়েক শ বছর ধরেই চলছে ব্যবসাটি। উচ্চ সুদ ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বহুকাল ধরেই চলে আসছে এ ব্যবসা। দীর্ঘকাল ধরে নীরবে চলে আসা এ ব্যবসা করোনায় একেবারে চুপসে গেছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে তাঁতীবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনায় অন্য সব ব্যবসার মতো বন্ধকি ব্যবসাও প্রথম তিন মাস বন্ধ ছিল। এরপর যখন দোকান খোলা হয়, তখন বন্ধকি ব্যবসায়ীরা ভেবেছিলেন করোনার কারণে অর্থ সংকটে পড়া মানুষের কারণে তাঁদের ব্যবসা বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি, বরং ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আগে যাঁরা ঋণ নিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না।
তাঁতীবাজারে স্বর্ণালংকারের প্রায় এক হাজার দোকানের মধ্যে ২০০টিতে বন্ধকি কারবার হয়।
বন্ধকি ঋণের বিপরীতে মাসে ২-৫ শতাংশ ও বছরে ২৪-৬০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হয়।
তাঁতীবাজারে স্বর্ণালংকারের বাজারে প্রায় এক হাজার দোকান, যার মধ্যে অন্তত ২০০টি দোকানে শুধু বন্ধকি কারবার হয়। মূল গ্রাহক আশপাশের ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায় যখন মন্দা যায়, তখন স্বর্ণালংকার রেখে টাকা ধার নেন। আবার যখন হাতে টাকা আসে, তখন ছাড়িয়ে নেন স্বর্ণালংকার। বিশ্বের অনেক দেশে সোনার বিপরীতে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ সুযোগ কম। তাই চাহিবামাত্র ঋণ পাওয়া যায়, নেই কোনো কাগজপত্রের ঝামেলা—এ জন্য অনেকেই স্বর্ণালংকার বন্ধক রেখে চড়া সুদের বন্ধকি ঋণ নেন। এ ধরনের ঋণের বিপরীতে মাসে ২-৫ শতাংশ ও বছরে ২৪-৬০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) কোষাধ্যক্ষ পবিত্র চন্দ্র ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁতীবাজারে স্বর্ণালংকার বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার নিয়ম হচ্ছে, সোনার ক্যারেটের হিসাব করে প্রতি ভরির যে দাম আসে, ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দাম তার ২০ শতাংশ কম ধরা হয়। সেই দামেরও ১০ শতাংশের মতো কম টাকা ঋণ হিসেবে গ্রাহককে দেওয়া হয়। ধরুন, প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট সোনার বাজারমূল্য এখন ৭২ হাজার ৬০০ টাকা। সেখান থেকে ২০ শতাংশ বাদ দিলে হয় ৫৮ হাজার ৮০ টাকা। এর বিপরীতে গ্রাহক সর্বোচ্চ ৫২ হাজার টাকা ঋণ নিতে পারবেন। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে সুদ দিতে হবে।
আগে যেখানে দৈনিক ১০ জন আসতেন বন্ধক রাখতে, এখন আসেন মাত্র দু–তিনজন। এমনও দিন যায় যে কেউই আসেন না।মো. সাইফুল, ব্যবস্থাপক, তাজমহল জুয়েলার্স
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁতীবাজারের বন্ধকি ব্যবসার সুদের হার নির্ধারণের সঠিক কোনো নিয়মনীতি নেই। একেকজনের ক্ষেত্রে সুদের হার একেক রকম হয়। তবে পুরো ব্যবসাই চলে বিশ্বাসের ওপর। তবে আশপাশের ব্যবসায়ীরাই ঋণ নিতে বেশি আসেন। এমন এক ঋণগ্রহীতা নবাবপুরের ব্যবসায়ী আবু সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাল আনব, হাতে টাকা নেই, তাই বোনের স্বর্ণ বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছি। মাল বিক্রি করে হাতে টাকা এলে স্বর্ণ ছাড়িয়ে নেব।’
ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার কারণে সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেওয়ায় অনেক গ্রাহকের বন্ধক আটকে গেছে। তাজমহল জুয়েলার্সের ব্যবস্থাপক মো. সাইফুল বলেন, আগে যেখানে দৈনিক ১০ জন আসতেন বন্ধক রাখতে, এখন আসেন মাত্র দু–তিনজন। এমনও দিন যায় যে কেউই আসেন না।
বাজুসের কোষাধ্যক্ষ পবিত্র চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে যে বন্ধক ছাড়িয়ে নেওয়া কমে যাওয়ায় আমরা হয়তো লাভবান হচ্ছি। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। ঋণগ্রহীতাদের সুবাদেই আমাদের ব্যবসা টিকে থাকে। তাঁদের সংখ্যা কমে গেলে আমাদের ব্যবসা লোকসানে পড়ে।’