ন্যাশনাল ব্যাংক ঘিরে আলোচনা নতুন নয়। ২০২১ সাল জুড়েও ব্যাংকটিকে ঘিরে ছিল বড় আলোচনা। বেনামি ঋণ ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর বছরের শেষ পর্যায়ে এসে ব্যাংকটির এমডিকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এর নেপথ্যে ছিল ব্যাংকের অন্যতম মালিক সিকদার পরিবারের ক্রেডিট কার্ডের অর্থ খরচের তথ্য গোপন রাখায় তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
শুধু ন্যাশনাল ব্যাংকই নয়, নতুন প্রজন্মের ইউনিয়ন ব্যাংক নিয়েও বছরের শেষ দিকে এসে ব্যাপক আলোচনা হয়। ইসলামি ধারার এই ব্যাংকের ঢাকার গুলশান শাখার ভল্টে ১৯ কোটি টাকার গরমিল ধরা পড়ে। কিন্তু এ জন্য কারও কোনো শাস্তি হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বড় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে দোষী ব্যক্তিরা এখনো অগোচরেই রয়ে গেছেন।
ন্যাশনাল ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক বেনামি ঋণ ঠেকাতে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ বিতরণে চলতি বছরের ৩ মে নিষেধাজ্ঞা দেয়। পাশাপাশি ব্যাংকটিতে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিয়োগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। এরপর থেকে ব্যাংকটি কোনো ঋণ দিতে পারছে না। আর ইচ্ছেমতো যে কাউকে নিয়োগও দেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া শীর্ষ গ্রাহকদের ঋণ আদায়ের বিষয়ে তদারকি জোরদার করা হয়েছে।
এই বছরে ন্যাশনাল ব্যাংককে নিয়মের মধ্যে ফেরানোর চেষ্টা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে শেষ চেষ্টা হিসেবে শেষ মুহূর্তে বেসিক ব্যাংক এবং সাবেক ফারমার্স (এখন পদ্মা) ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই উদ্যোগ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাংক দুটিকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। এখন ন্যাশনাল ব্যাংকের বিষয়ে একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এতে কতটা ফল মিলবে তা সময়ই বলে দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি দিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দেয়। চিঠিতে বলা হয়, ঋণ ও আমানতের অনুপাত ৮৭ শতাংশে না আসা পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংক কোনো ঋণ বিতরণ করতে পারবে না। চিঠি পাঠানোর সময় ব্যাংকটির ঋণ-আমানতের অনুপাত ছিল ৯২ শতাংশ। আর গত নভেম্বরে তা কমে হয়েছে ৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে ২ শতাংশ ওপরে আছে।
তখন ব্যাংকটির জন্য বড় অঙ্কের ঋণ এবং একক গ্রাহকের ঋণসীমাও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুনভাবে নির্ধারণ করে দেয়। সে অনুযায়ী ব্যাংকটির বড় ঋণের সীমা হবে পরিশোধিত মূলধনের ৫ শতাংশ। যেহেতু পরিশোধিত মূলধন ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা, সেহেতু বড় ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ১৫৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে একক গ্রাহক ঋণসীমা হবে পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশ বা ৩০৬ কোটি টাকা। এই সীমা নগদ ঋণ (ফান্ডেড) ও ঋণ সুবিধা (নন-ফান্ডেড) ঋণসহ। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংক অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনো ঋণ অধিগ্রহণ বা কিনতে পারবে না।
এত সব নির্দেশনা দেওয়া হলেও কিন্তু ন্যাশনাল ব্যাংকে অনিয়ম কমেনি। এখন বড় গ্রাহকদের পুরো সুদ মওকুফ করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছেন কয়েকজন পরিচালক। এতে ব্যাংকটি আরও বড় ঝুঁকিতে পড়ছে।
পাশাপাশি শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে ঋণ আদায়ের তথ্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে বলা হয়েছে। ব্যাংকটির বিভিন্ন প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ২০ গ্রাহকের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো এস আলম গ্রুপ, মাইশা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, সাদ মুসা, নাফ ট্রেডিং, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, এফএমসি ডকইয়ার্ড, প্রাণ-আরএফএল, ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনাল, ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট।
ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকট হওয়ার পরই মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদক্ষেপ নেয়। এক পক্ষ ব্যাংকটিকে ভালো করার উদ্যোগ নিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়।
গত ২৪ নভেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহ সৈয়দ আবদুল বারীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। তাঁকে ব্যাংকের অন্যতম মালিক সিকদার পরিবারের কয়েকজন সদস্য পদত্যাগে বাধ্য করেন বলে কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে। এর নেপথ্যে ছিল ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে সিকদার পরিবারের সদস্যদের অর্থ খরচ করার তথ্য গোপন রাখার ঘটনা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ধরা পড়ে, ন্যাশনাল ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে প্রায় ৩০ লাখ ডলার (২৫ কোটি টাকার মতো) খরচ করেছেন এর অন্যতম মালিক সিকদার পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু সেই খরচের (ঋণ) তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) জমা দেয়নি ন্যাশনাল ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক চিঠি দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানতে চেয়েছে, কেন ন্যাশনাল ব্যাংককে জরিমানা করা হবে না। এদিকে এমডিকে পদত্যাগে বাধ্য করে সিকদার পরিবার। আর এমডিকে পদত্যাগে বাধ্য করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি পক্ষ মৌখিকভাবে সমর্থন দিয়েছে বলে জানা গেছে।
ইতিমধ্যে ব্যাংকটিতে নতুন এমডি যোগ দিয়েছেন। ঋণ বিতরণের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ওঠে যাবে। ফলে নতুন বছরে ব্যাংকটি কোনদিকে যাবে, সেটি এখন দেখার অপেক্ষা।
অবশ্য গত দেড় দশকে ব্যাংকটির বেশির ভাগ এমডিই পর্ষদের চাপে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। যে কারণে ২০১৪ সাল থেকে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
ইউনিয়ন ব্যাংকের ভল্টে গরমিল
দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতি নিয়ে বছরজুড়ে আলোচনা থাকলেও আগে কখনো ভল্টের টাকায় হাত দেওয়ার খবর মেলেনি। সেটিই ঘটেছে চলতি ২০২১ সালে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি পরিদর্শক দল গত গত ২০ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির গুলশান শাখায় গিয়ে ভল্টে টাকার হিসাবে গরমিল দেখতে পায়। বছর একেবারে শেষ হয়ে আসলেও ভল্টে টাকায় গরমিল থাকার প্রকৃত কারণ বের হয়নি। আর কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি ন্যাশনাল ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ব্যাপারে আর পরিদর্শন বা তদন্ত করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমনকি সিসিটিভি ফুটেজও দেখা হয়নি। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
ইসলামি ধারায় পরিচালিত ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখার ভল্টে ৩১ কোটি টাকা থাকার তথ্য উল্লেখ ছিল কাগজপত্রে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ভল্ট খুলে টাকা গুনে দেখেন তাতে রয়েছে ১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ভল্টে প্রায় ১৯ কোটি টাকা কম পান তাঁরা। ভল্টের টাকায় বিশাল ঘাটতি থাকার বিষয়ে শাখাটির কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলকে যথাযথ কোনো জবাব দিতে পারেননি।
নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকের ভল্টের টাকায় গরমিল থাকলে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হয়। কিন্তু ব্যাংকটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ করেনি কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানায়নি। ফলে এই ঘটনার প্রকৃত কারণ এখনো উদ্ঘাটিত হয়নি।
এদিকে ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সংলগ্ন গুলশান শাখার ভল্টে ১৯ কোটি টাকা গরমিলসংক্রান্ত তদন্তের অগ্রগতি জানতে চেয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ ব্যাপারে ১৩ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভল্টে টাকা কেন কম হয়েছিল, সেই জবাব আমরা পেয়েছি। এ জন্য বাড়তি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’