প্রবৃদ্ধির পেছনে বৈষম্যের গল্পও আছে
দেশে একদিকে প্রবৃদ্ধির আলেখ্য নিয়ে সন্তুষ্টি তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে বৈষম্য ও পিছিয়ে পড়ার গল্পও আছে। কোভিড-১৯-এর কারণে এই পিছিয়ে পড়া মানুষেরা আরও পিছিয়ে পড়েছে। সে জন্য অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য কর্মসংস্থানমুখী পরিকল্পনা করতে হবে।
বৃহস্পতিবার নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা: জাতীয় উন্নয়ন ও পিছিয়ে পড়া মানুষের স্বার্থ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
প্রান্তিক মানুষদের অনেকে আবারও দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। বৈষম্য আরও বেড়েছে—ভোগ ও আয়বৈষম্য উভয়ই। সে জন্য এই জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কতটা প্রতিফলিত হয়েছে, তা দেখতে হবে। এই পরিকল্পনা আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে।
সিটিজেন প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মেয়াদে বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে বেশ কিছু অর্জন করেছে—এই সময়ে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে, ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার শর্ত পূরণ করেছে।
এ ছাড়া আরও কিছু অর্জনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। সেগুলো হচ্ছে, এই পাঁচ বছরে দেশে প্রায় এক কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমা থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার অর্জিত হয়েছে। পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। স্থিতিশীল ছিল টাকার বিনিময় হার। আয়ু বেড়েছে। সাক্ষরতা বেড়েছে ১০ শতাংশের মতো। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ১২ শতাংশ। বড় অর্জন আছে জ্বালানি খাতে—৪২ শতাংশ উৎপাদন বেড়েছে। রেমিট্যান্স বেড়েছে ২০ শতাংশ। মোট দেশজ উৎপাদনে উৎপাদন খাতের অবদান বেড়েছে ৫ শতাংশ। এ ছাড়া শত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ তুলনামূলক সফল বলে উল্লেখ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
কিন্তু কথা হচ্ছে, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষেরা এই উন্নয়নের ভাগীদার হয়েছে কি না। কারণ, বৈষম্যের হার বাড়ছে—২০১৬ সালে যেখানে আয়ের জিনি সহগ ছিল ০.৪৮, ২০২০ সালে তা ০.৫২-এ পৌঁছেছে। কোভিডের ধাক্কার কারণে এবার আরও বেশি করে পিছিয়ে পড়া মানুষের চিন্তা করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
উন্নয়নের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিদেশি বিনিয়োগ থেকে শুরু করে রাজস্ব আদায়— প্রায় সব ক্ষেত্রেই সরকার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলেও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকের এই পাঁচ বছরে প্রবৃদ্ধির হার লক্ষ্য অনুযায়ী অর্জিত হয়েছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের প্রশ্ন, এটা কি পরিকল্পনার দুষ্টচক্র, নাকি তথ্যের ভ্রান্তি।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে যত আলোচনা হয়, তার বেশির ভাগই পরিসংখ্যান ও কৌশল নিয়ে। এই পরিস্থিতিতে আলোচনা শহরের টেবিল থেকে তৃণমূলে নিয়ে যেতে হবে বলে মনে করেন সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। নাগরিক প্ল্যাটফর্মকে এখন যেটা করতে হবে সেটা হলো, সরকারের এই পরিসংখ্যান রক্ত-মাংসের মানুষের জীবনে কী প্রভাব ফেলছে, তা পরিমাপ করা। কীভাবে সরকারের ঘোষিত নীতিমালা তৃণমূলে বাস্তবায়িত হচ্ছে, প্ল্যাটফর্মের তৃণমূলের সদস্য সংগঠনগুলোর কাছ থেকে সময়-সময় সেই খবর নিতে হবে বলে তাঁর মত। মানুষের জীবনে এসবের কী প্রভাব, তা নিরূপণ করতে হবে।
সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ হচ্ছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। কিন্তু সেই মানুষেরা যে রাষ্ট্রের কাছে সরাসরি নিজেদের কথা বলবে, সেই প্রক্রিয়া নেই বলে অভিযোগ করেন সঞ্জীব দ্রং। বাংলাদেশে ইন্ডিজেনাস পলিসি নেই বলে আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ভারতের নেহরু সরকার ১৯৫৯ সালে এ রকম নীতি প্রণয়ন করলেও বাংলাদেশ এখনো সে রকম নীতি করতে পারেনি। আর এই মানুষদের সমস্যা হৃদয় দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে বলে তিনি মত দেন।
ওয়েবিনারে আরও বক্তব্য দেন সাংসদ আব্দুস শহীদ, সাংসদ ও অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, রাশেদা কে চৌধূরী, আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ প্রমুখ।