প্রণোদনার তালিকায় পণ্যের নতুন নাম
রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা পাওয়ার তালিকায় নতুন নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ১৬ জুলাই একটি তালিকা পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অর্থ মন্ত্রণালয় এখন সেসব পণ্যের খুঁটিনাটি যাচাইয়ের পাশাপাশি প্রণোদনা দেওয়ার যৌক্তিকতা খুঁজছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২৪টি পণ্যকে নতুন করে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ১৪টি একেবারেই নতুন, কোনো প্রণোদনা পায় না। আর বাকি ১০টি পণ্যে প্রণোদনা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। একেবারে নতুন যেসব পণ্যে প্রণোদনার কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে ৯টিকে ১৫ শতাংশ, ২টিকে ১০ শতাংশ, ২টিকে ২০ শতাংশ ও ১টিকে ৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
গত মাসে সংশ্লিষ্ট একাধিক মন্ত্রণালয়, সরকারি সংস্থা, ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধি, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আবেদনকারী ব্যবসায়ীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত দুটি বৈঠকের মতামতের ভিত্তিতে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা ২০১৯ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ৩৭টি শ্রেণির ৪৭ ধরনের পণ্য এখন বিভিন্ন হারে প্রণোদনা পায়। এর মধ্যে ৮টি পণ্য ২০ শতাংশ, ৫টি ১৫ শতাংশ এবং ১৯টি ১০ শতাংশ হারে প্রণোদনা পায়। বাকিগুলোতে দেওয়া হয় ১ থেকে ৯ শতাংশ হারে প্রণোদনা।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ‘রপ্তানি প্রণোদনা’ বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ৭ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের মূল ও সংশোধিত—উভয় বাজেটে পরিমাণটি চলতি অর্থবছরের সমানই ছিল।
জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানি প্রণোদনার সঙ্গে জড়িত সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে এবং সবার মতামতের ভিত্তিতেই সুপারিশ করা হয়েছে। আশা করছি, ঈদের পর অর্থ মন্ত্রণালয় একটি বৈঠক করবে এবং সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।’
শতভাগ মূল্য সংযোজন ৯ পণ্যে
জীবন্ত কাঁকড়া ও কুঁচে মাছ
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, করোনার কারণে জীবন্ত কাঁকড়া ও কুঁচে মাছ রপ্তানি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা। তাই এ পণ্যে বিদ্যমান ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ দুই পণ্য শতভাগ মূল্য সংযোজন করে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
কাজুবাদাম
বিশ্ববাজারে কাজুবাদামের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই বাংলাদেশেও এটির চাষাবাদ বাড়ছে। কৃষিপণ্যের আওতায় বর্তমানে শাকসবজি ও ফলমূল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হলেও অপ্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম এ সুবিধা পায় না। আবার প্রক্রিয়াজাতকৃষিপণ্যে ২০ শতাংশ প্রণোদনা থেকেও কাজুবাদাম বাদ। তাই অপ্রক্রিয়াজাত ও প্রক্রিয়াজাত—উভয় ধরনের কাজুবাদামে ২০ শতাংশ প্রণোদনার সুপারিশ করা হয়।
রিসাইকেল্ড পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবার (পিএসএফ)
এর কাঁচামাল হচ্ছে পেট বোতল ফ্লেক্স। পেট বোতল ফ্লেক্স উৎপাদনে ৪টি ধাপ থাকলেও পিএসএফ উৎপাদনে রয়েছে ৯টি ধাপ। বর্তমানে উভয় পণ্যে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হয়। সেটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অপ্রচলিত লেচিথিন ও সয়া অ্যাসিড তেল
তৈলবীজের উপজাত পণ্য লেচিথিন ব্যবহৃত হয় পোলট্রি ফিড, ফিশ ফিড ও পেইন্ট শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে। উৎপাদনক্ষমতা ১০ হাজার টন, স্থানীয় চাহিদা ৩ হাজার টন। আর সয়া অ্যাসিড তেল হচ্ছে সয়াবিন বীজ পরিশোধনকালে পাওয়া উপজাত। এর উৎপাদনক্ষমতা ৩০ হাজার টন, স্থানীয় চাহিদা ৮ হাজার টন। এটি ডিজেল ইঞ্জিনের জ্বালানি, ডিটারজেন্ট, প্রসাধনশিল্পে ব্যবহৃত হয়। এ খাতে ১০ শতাংশ প্রণোদনা চাওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া টিএসএনআর এবং লেটেক্সে ১৫ শতাংশ, পোশাক খাতের ঝুট ও ঝুট থেকে তুলায় ৫ শতাংশ; হস্তশিল্পে১০ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ; সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার ও আইটিইএসে ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ এবং পাটজাত পণ্যে বর্তমানের ২০ শতাংশ বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে।
৬টি আছে বর্ষপণ্য-২০২০ থেকে
মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল
এটি প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত বর্ষপণ্য। ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রপ্তানিতে পরিণত বাজারের অধিকারী চীন ও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে এ পণ্যকে। প্রণোদনা বাড়িয়ে তাই দ্বিগুণ, অর্থাৎ ২০ শতাংশ করা উচিত।
ফটোভলটিক মডিউল বা সোলার এনার্জি
হালকা প্রকৌশল খাতের এ পণ্য বিদ্যমান রপ্তানি নীতিতে অগ্রাধিকারমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমানে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হলেও তা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ইলেকট্রিক্যাল পণ্য
টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওভেন, জুস ব্লেন্ডার, এয়ারকুলার, এলইডি লাইট, ফ্যান ও সুইচ-সকেটে বর্তমানে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা পাচ্ছে। তবে এগুলোর জন্য আমদানি করা কাঁচামাল উচ্চ শুল্ক দিতে হয়। তাই প্রণোদনা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ ছাড়া রপ্তানি নীতিতে বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পণ্য খেলনা ২০ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অটোমোবাইল শিল্পের ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ লিফ স্প্রিং ১৫ শতাংশ এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) থাকা সি ক্যাটাগরির কোম্পানিতে তৈরি অ্যাকুমুলেটর ব্যাটারিতে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্কিং অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ভালো উদ্যোগ। তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলে, প্রণোদনা পেয়েও কোনো কোনো খাতের রপ্তানি কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়। রপ্তানি বৃদ্ধি শুধু প্রণোদনার মধ্যে নয়, অন্য সমস্যা সমাধানের সঙ্গেও জড়িত। ফলে সার্বিকভাবে একটা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
১৫ শতাংশ প্রণোদনার আরও দাবিদার
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, মাছের আঁশকে মাছ বা কৃষিপণ্যের মধ্যে না রেখে আলাদা হেড তৈরি করা যেতে পারে। যেমন কৃষিপণ্য হওয়া সত্ত্বেও আলু, জুট পার্টিকেল বোর্ড উৎপাদিত কার্বনকে আলাদা হেডে রাখা হয়েছে। স্থানীয় বাজারে মাছের আঁশের দাম বাড়ায় বিশ্ববাজারে তা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে। তাই ১৫ শতাংশ হারে প্রণোদনার সুপারিশ করা হয়েছে।
সিমেন্টশিল্পের সহযোগী সিমেন্ট শিট আমদানি করা কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয় চাহিদা ২ লাখ ২৫ হাজার টন হলেও উৎপাদনক্ষমতা আছে ৫ লাখ টনের। এখন ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। এই পণ্য ১৫ শতাংশ প্রণোদনার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ছাড়া মিথাইল মিথাক্রাইলেটেড মনোমার নামের উন্নত মানের প্লাস্টিক পণ্যের স্ক্র্যাপ বিভিন্ন সাজসজ্জা ও উপহারসামগ্রী, সাইনবোর্ড, চশমার গ্লাস, লেটার কাটিং, ফলস সিলিং ও বিভিন্ন তৈজস পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এই পণ্য উৎপাদনে যেসব কাঁচামাল লাগে, তাতে ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক রয়েছে। সব মিলিয়ে শুল্ক ৩১ শতাংশ। নতুন হিসেবে ১৫ শতাংশ প্রণোদনার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া ফ্লোট গ্লাস শিট, কাচের তৈরি তৈজসপত্রে (ওপাল গ্লাসওয়্যার), দেশে উৎপাদিত কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য, বায়াক্সিয়ালি ওরিয়েন্টেড পলিপ্রোপাইলিন ফিল্মস, হাইড্রো ক্লোরো ফ্লোরো কার্বনমুক্ত (এইচসিএফসি) ইলেকট্রনিক পণ্য এবং শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র এবং মোটরযানের কমপ্রেসর তৈরির ১৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি শামস মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণের বিষয় বিবেচনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু শুধু প্রণোদনা দিলেই একটা খাতকে দাঁড় করানো যায় না, যদি না কর নীতিসহ অন্য নীতিগুলোকেও রপ্তানি সহায়ক করা হয়।’