পাটকল শ্রমিক ক্ষুব্ধ, জটিলতার শঙ্কা
বছরের পর বছর ধরে লোকসান গোনায় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা অবসরে (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। তবে বিষয়টি সহজভাবে নিচ্ছেন না পাটকলশ্রমিকেরা। তাঁরা স্বেচ্ছা অবসরের প্রতিবাদে জোটবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রয়োজনে আমরণ অনশনে যাবেন তাঁরা। ফলে বিজেএমসির প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতার শঙ্কা রয়েছে।
শ্রমিকনেতারা বলছেন, যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন ও সময়মতো কাঁচা পাট কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিলেই সরকারি পাটকলগুলো লাভের মুখ দেখবে। বিজেএমসির দুর্বল বিপণন ব্যবস্থাপনা জোরদার ও দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদেরও অপসারণ করতে হবে। বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থ ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’ হিসেবে না দিয়ে পাটকলের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করার আহ্বান জানান তাঁরা।
>গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিজেএমসি। এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন শ্রমিকেরা।
এদিকে গত ১০ বছরের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো কেবল একবার লাভের মুখ দেখেছে। ১০ বছরে লোকসানের পরিমাণ ৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যে ৫৭৩ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে, তা তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এদিকে দেশে ও বিদেশে বিজেএমসির পাটপণ্য বিক্রির আয়ও হঠাৎ করে অর্ধেকে নেমেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১ হাজার ১৬৪ কোটি টাকার পণ্য বিক্রির বিপরীতে গত অর্থবছর তা কমে হয়েছে মাত্র ৫৯২ কোটি টাকা।
অবশ্য রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে লাভজনক করতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৮ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছিল বিজেএমসি। এর মধ্যে ছিল পাটকলের জমি লিজ দেওয়া, কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে পাট কিনতে ১ হাজার কোটি টাকার ঘূর্ণমান তহবিল গঠন, বহুমুখী পাটপণ্যের কারখানা স্থাপন, ২২ পাটকলের বিএমআরই ও উৎপাদিত পণ্য দ্রুত বিক্রি করা ইত্যাদি।
বিজেএমসির কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো কিছুই ঠিকমতো হচ্ছিল না। তাই সরকার আর পাটকলের লোকসানের বোঝা বইতে চাইছে না। সে জন্য স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা অবসরে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেটি শেষ হলে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে পাটকলগুলো চালানো হবে। পাটকলের ব্যবস্থাপনাও বেসরকারিকরণ করা হবে। কর্মসূচি অনুযায়ী সেপ্টেম্বর থেকে শ্রমিকদের অর্থ দেওয়া শুরু হতে পারে।
শ্রমিকদের স্বেচ্ছা অবসরে পাঠানোর প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শনিবার খুলনায় পাটকলগুলোর গেটে গেটে শ্রমিকসভা হয়েছে। আজ রোববার খুলনার খালিশপুরের চিত্রালী এলাকার জুট ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলনে করে দাবি তুলে ধরবেন শ্রমিকেরা। দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন শুরু হবে বলে জানালেন কয়েকজন শ্রমিকনেতা।
জানতে চাইলে খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের সাবেক সিবিএ সভাপতি খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকেরা কেউ চান না পাটকল স্থায়ীভাবে বন্ধ হোক। এ জন্য তাঁরা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কর্মসূচি থেকে আমরণ অনশনের ডাক আসতে পারে।
খলিলুর রহমান আরও বলেন, লোকসানের কথা বলে সরকারি পাটকল বন্ধ করা হচ্ছে। তবে লোকসান হয় কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও নীতি নির্ধারণের কারণে। ভরা মৌসুমে পাট কেনা হলে ও উৎপাদিত পণ্য ঠিকমতো বিক্রির ব্যবস্থা করলে মিলগুলো লাভের মুখ দেখবে বলে দাবি করেন তিনি।
বিজেএমসির অধীন ২৬টি পাটকলের মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন–জুট কারখানা। ঢাকা অঞ্চলে ৭টি, চট্টগ্রামে ১০টি ও খুলনা অঞ্চলে ৯টি পাটকল রয়েছে। পাটকলগুলোতে বর্তমানে স্থায়ী শ্রমিক আছেন ২৪ হাজার ৮৫৫ জন। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত বদলি ও দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। তবে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় থাকবেন কেবল স্থায়ী শ্রমিকেরা। এ ছাড়া কর্মচারীদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।
শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের প্রক্রিয়া শুরু হলেও পাটকলগুলোর উৎপাদন চলছে। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিজেএমসির খুলনার আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বনিজ উদ্দিন মিয়া গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জুলাই ও আগস্ট দুই মাস খাদ্য অধিদপ্তরের বস্তা তৈরির ক্রয়াদেশ রয়েছে। তিনি বলেন, কোন পদ্ধতিতে শ্রমিকদের ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’ দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করা হয়নি।
শ্রমিক আন্দোলনের কারণে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক বাধাগ্রস্ত হবে কি না, জানতে চাইলে বিজেএমসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রউফ গতকাল বলেন, আইনশৃঙ্খলা দেখার দায়িত্ব বিজেএমসির কাজ না। বিষয়টি দেখবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সে জন্যই গত বৃহস্পতিবার একটি বৈঠক হয়েছে। তিনি বলেন, পাটকলশ্রমিকেরা ভুল বুঝছেন। সরকারি পাটকল কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। সেগুলো পরিচালনার কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বিজেএমসির চেয়ারম্যান বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো কোনো দিক দিয়েই ঠিকমতো চলছে না। বেসরকারি পাটকলের চেয়ে খরচ তিন গুণ বেশি। ফলে সরকার টাকা দিলেও পাটকলগুলো চালানো সম্ভব না। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেলেই গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের কাজ শুরু হবে।
অভিমত : পাটকলগুলো পুনর্গঠনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত জরুরি
সরকারি পাটকলের সঙ্গে একদিকে শ্রমিকের স্বার্থ জড়িত, অন্যদিকে সেগুলোতে বড় ধরনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি রয়েছে। প্রতিবছর করদাতাদের শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে পাটকলগুলো চালু রাখতে হচ্ছে। তারপরও প্রায় সব কটিই লোকসান গুনছে। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি।
পাটকলগুলোর আকার যুক্তিসংগত পর্যায়ে নামিয়ে আনার পাশাপাশি যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন করে সরকারি খাতে রেখে বা ব্যবস্থাপনা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে কিংবা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিই) ভিত্তিতে পরিচালনার মাধ্যমে পুনর্গঠন সম্ভব। বর্তমানে পিপিপির মাধ্যমে পরিচালনার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে করতে হবে। পাটকলগুলো পরিচালনার জন্য কাদের দেওয়া হবে, সেটি যেন রাজনৈতিক বিবেচনায় না হয়। অতীতে অন্যান্য খাতের বেলায় এমন ঘটনা ঘটেছে। বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পর সরকারি কলকারখানার জমি হাতছাড়া হয়ে গেছে। অনেকগুলোর চরিত্রই পাল্টে ফেলা হয়েছে।
পিপিপির মাধ্যমে পাটকলগুলো লাভজনক করতে হলে ভালো পরিকল্পনা থাকতে হবে। আধুনিক যন্ত্রপাতি বসাতে হবে। বর্তমানের মতো অনেক শ্রমিক প্রয়োজন হবে না। সে জন্য শ্রমিকের ন্যায্য দেনা–পাওনা পরিশোধের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আমি আবারও বলব, সরকারি পাটকলের পুনর্গঠনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বব্যাপী পাটপণ্যের চাহিদা বর্তমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে জন্য সরকারকে বাংলাদেশি পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্র্যান্ডিং করতে হবে। তাহলে পাটচাষি থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তারা লাভবান হবেন।