পাচারের টাকা বৈধতার সুযোগ অগ্রহণযোগ্য: সিপিডি
বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক—তিনভাবে অগ্রহণযোগ্য বলছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলেছে, পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার বৈধতা দিলে যাঁরা নিয়মিত কর দেন, তাঁরা হতাশ হবেন। যাঁরা সৎভাবে ব্যবসা করছেন, তাঁরা কর দিতে নিরুৎসাহিত হবেন। পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগকে সিপিডি সমর্থন করে না।
প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ওপর পর্যালোচনা তুলে ধরে সিপিডি আরও বলেছে, আগামী অর্থবছর সরকার মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। কিন্তু কোন জাদুবলে এ লক্ষ্য অর্জিত হবে অর্থমন্ত্রী তা বলেননি।
আজ শুক্রবার রাজধানীর হোটেল লেকশোরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ সময় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সংস্থাটির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
বৃহস্পতিবার সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পাচার হওয়া টাকা সাড়ে সাত শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগের প্রস্তাব করেন। প্রথমবারের মতো পাচারকারীদের এ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সাড়ে সাত শতাংশ কর দিয়ে টাকা আনলে দেশের অন্য কোনো আইনে তাঁকে প্রশ্ন করা হবে না।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি থাকলে দেশের আয়কর রিটার্নে দেখাতে চাইলে ১৫ শতাংশ আয়কর দিতে হবে। এ ছাড়া অস্থাবর সম্পত্তির ওপর ১০ শতাংশ এবং পাচার হওয়া টাকা দেশে আনলে সেই টাকার ওপর ৭ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে দেখাতে পারবেন যে কেউ। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেবে না সরকার। তাঁকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।
আজকের সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, এর আগেও দেখা গেছে বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু খুব কমসংখ্যকই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছে। এবার পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। এটা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক তিনভাবেই অগ্রহণযোগ্য।
পি কে হালদারের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এই ঘোষণার পর বিদেশে পালিয়ে থাকা কেউ একজন যদি কর দিয়ে টাকা নিয়ে আসতেন তাহলে কি করা যেত? তবে এ সুযোগ খুব একটা কাজে আসবে না বলে মনে করেন তিনি। বরং ভবিষ্যতে টাকা আরও পাচার হওয়ার প্রবণতা তৈরি হবে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ সময়ে কেউ টাকা দেশে ফেরত আনবে না।
প্রস্তাবিত বাজেটে বিশেষ কিছু মানুষকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করে সিপিডি। সংস্থাটি বলছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেই। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়েনি।
সিপিডি বলছে, বাজেটে সৃজনশীলতার মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। সংবেদনশীলতার অভাব রয়েছে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। বাজারে গেলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে দাম, তার সঙ্গে সরকারের তথ্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী হয়তো ভাবছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা মহামারিসহ বর্তমান সংকট দ্রুত কেটে যাবে। কিন্তু কোন জাদুর কাঠি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো হবে, সে পথ দেখাননি অর্থমন্ত্রী।
তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে যাঁরা সম্পদশালী, ধনিক শ্রেণি তাঁদের জয়টাই বেশি দেখা যাচ্ছে। সে অর্থে গরিবদের জন্য সুবিধা দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, এ বাজেটে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্তের জন্য বাজেটে কিছু দেখা গেল না। ল্যাপটপের ওপর করহার বাড়ানো ঠিক হয়নি। এতে বোঝা যাচ্ছে যাঁরা বাজেট তৈরি করেন, তাঁদের বর্তমান বাজারের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই।
নিজের মন খারাপের কথা উল্লেখ করে তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, এমন একটি বাজেট দেওয়া হলো যেখানে পাচারকারীদের দেশে টাকা ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া হলো। অথচ কর ফাঁকি রোধে কঠোর কোনো পদক্ষেপের কথা বলা হলো না। প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ নেই।
সিপিডি বলেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তার কোনো কৌশল বাতলে দেননি তিনি। তা ছাড়া আগামী বছর নির্বাচন। বাজেটে নির্বাচনমুখী কিছু দেখা গেল না। তা ছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে নারীদের জন্য বরাদ্দ কমেছে। সামাজিক সুরক্ষা খাতেও বরাদ্দ কমেছে। এ দুই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগকে সৎ করদাতাদের জন্য চপেটাঘাত। এটি শুধু সুযোগই নয়, ওই ব্যক্তির জন্য দায়মুক্তিরও সুযোগ। সরকার এই সিদ্ধান্ত নেবে না এবং এখান থেকে সরে আসবে বলে প্রত্যাশা করেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তা অর্জিত হবে না বলে মনে করে সিপিডি। এ বছর জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ছাড়া রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য উচ্চাভিলাষী বলছে সিপিডি। এ লক্ষ্যও অর্জিত হবে না।