পরিবেশবান্ধব ইট ব্যবহার পথ দেখাল কনকর্ড
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীর ঘাটের পাশে উৎপাদন হচ্ছে ইট, হলো ব্লক ও টাইলস। নদীপথে আসছে মাটি, সিমেন্ট ও পাথর। তা দিয়েই তৈরি হচ্ছে এসব নির্মাণসামগ্রী। তবে আকাশে উড়ছে না কোনো কালো ধোঁয়া বা ধুলা। ভেতরে দেখা গেল, শুধু কালো ধোঁয়া কেন, এ কারখানায় কোনো ধোঁয়াই নেই। আধুনিক যন্ত্রে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব সব নির্মাণসামগ্রী, যাতে হাতের ছোঁয়াও সেভাবে লাগছে না।
পোড়ামাটির ইটের ব্যবহার বন্ধে ১৯৯৮ সালে কনকর্ড গ্রুপের এ উদ্যোগ এখন অন্যদেরও পথ দেখাচ্ছে। আরও অনেক কোম্পানি এ ব্যবসায় এসেছে। সরকারও চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে অবকাঠামো তৈরিতে ১০ শতাংশ পরিবেশবান্ধব ইট ব্যবহারের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নির্মাণে খাতে শতভাগ পরিবেশবান্ধব ইট ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। পোড়ামাটির ব্যবহার বন্ধে অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ কার্যক্রমও চালাচ্ছে সরকার।
আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কনকর্ডের পরিবেশবান্ধব ইট, হলো ব্লক, টাইলস তৈরির কারখানা দেখতে গত বৃহস্পতিবার গিয়েছিলাম মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায়। মেঘনা নদীর ধারে ৮ একর জায়গাজুড়ে কনকর্ড রেডি মিক্সড অ্যান্ড কংক্রিট প্রোডাক্টস লিমিটেডের একটি কারখানা, তার পাশেই ১১ একর জায়গাজুড়ে আছে আরেকটি কারখানা।
কারখানা দুটি ঘুরে দেখা গেল, দুটিতেই বিদেশ থেকে আনা যন্ত্রে উৎপাদন হচ্ছে নির্মাণসামগ্রী। স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ মাটি, সিমেন্ট ও পাথর এসে মিশে যাচ্ছে। এরপরই তৈরি হচ্ছে ইট বা ব্লক। পোড়ামাটির ইটের বিকল্প যে ব্লক বা ইট উৎপাদন হচ্ছে, তা পোড়ানোরও প্রয়োজন পড়ছে না। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন আকারের ও ধরনের ইট তৈরি হচ্ছে। একইভাবে পার্কিং টাইলস, সড়কপথের টাইলস, টেরাকোটা টাইলস, কারখানার জন্য অধিক ভার ধারণে সক্ষম টাইলসও উৎপাদন হচ্ছে।
কারখানাটিতে ১৯৯৮ সাল থেকে কাজ করছেন ডেপুটি ম্যানেজার প্রকাশ কুমার বিশ্বাস। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম কেন মানুষ এই ইট ব্যবহার করবে? তাঁর জবাব, পোড়ামাটির ইটের স্থায়িত্ব দিন দিন কমে আসে। আর হলো ব্লকের স্থায়িত্ব দিন দিন বাড়ে। কারণ, ব্লক তৈরি হয় সিমেন্ট, মাটি ও পাথর দিয়ে। আর পোড়ামাটির ইট তৈরি হয় শুধু মাটি দিয়ে।
দুটি কারখানা মিলে প্রায় ১১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। কারখানা হলেও পরিবেশ নিরিবিলি। নদীর পাড়ঘেঁষে গড়ে ওঠা কারখানাটির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এ ইট ও ব্লক উৎপাদনে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আবার বাড়ি নির্মাণে খরচও কম। সক্ষমতাও বেশি।
আরেকটি কারখানার ব্যবস্থাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘উন্নত দেশগুলো অনেক আগেই এসব সামগ্রী ব্যবহার শুরু করছে। আমাদেরও সময় এসেছে সেদিকে যাওয়ার।
১৯৯৮ সালে গড়ে ওঠা কনকর্ডের এ কারখানায় তৈরি ইটে কতটা ভবন নির্মাণ হয়েছে। এ ইটের প্রয়োজনীয়তা কী? এসব নিয়ে ঢাকায় কনকর্ডের প্রধান কার্যালয়ে কথা হয় গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহরিয়ার কামালের সঙ্গে। তিনি বলেন, কনকর্ড গ্রুপের চেয়ারম্যান এস এম কামালউদ্দিন ১৯৭৩ সালে গড়ে তোলেন এ প্রতিষ্ঠানটি। এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা নির্মাণ করেছে কনকর্ড। তার মধ্যে সাভারের স্মৃতিসৌধ, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শিল্প ব্যাংক ভবন, ইনডোর স্টেডিয়াম, আইডিবি ভবন, কনকর্ড পুলিশ প্লাজা অন্যতম।
শাহরিয়ার কামাল আরও বলেন, ‘বাবা যখন আবাসন ব্যবসা শুরু করেন, তখনই বুঝতে পেরেছিলেন ঢাকা মেগা সিটিতে রূপ নেবে। এ চাপ সামলানোর উপায় হলো সব সুযোগ-সুবিধা কাছাকাছি হতে হবে, পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। এ জন্য লেকসিটি কনকর্ডের মতো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।’
শুধু প্রকল্প হাতে নিয়েই বসে ছিলেন না এস এম কামালউদ্দিন, পাশাপাশি প্রকল্পটি যেন পরিবেশবান্ধব হয়, খোলামেলা থাকে, বাচ্চাদের খেলাধুলার জায়গা থাকে, এ চিন্তাও করেছিলেন। লেকসিটি প্রকল্পে পরিবেশবান্ধব সামগ্রী ব্যবহার করতে ১৯৯৮ সালে গড়ে তোলেন কনকর্ড রেডি মিক্সড অ্যান্ড কংক্রিট প্রোডাক্টস লিমিটেড। এটা নতুন কোনো প্রযুক্তি ছিল না, সারা বিশ্বে বেশ আগে থেকেই এমন ইট ব্যবহার হচ্ছে।
শাহরিয়ার কামাল বলেন, ‘ব্লকের ইট আমাদের জন্য যথাযথ। কারণ, যাঁরা মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরি করেন, তাঁরা অল্প প্রশিক্ষণে ব্লকের ইট তৈরি করতে পারবেন। আবার নির্মাণশ্রমিকেরাও সহজে এর ব্যবহার শিখতে পারবেন।’
১৯৯৮ সালের পর প্রায় ২০০টি প্রকল্প করেছে কনকর্ড। এর সব কটিতেই ব্যবহার করেছে পরিবেশবান্ধব ইট, হলো ব্লক, ইউনিপেভার্স ও টাইলস। এখনো সব ভবন ও সড়কেও এসব সামগ্রী ব্যবহার করছে।
কনকর্ডের এমডি বলেন, ‘ব্যবসার জন্য আমরা হলো ব্লক ব্যবহারের কথা বলছি না। পরিবেশ বাঁচাতে এর বিকল্প নেই। হলো ব্লকের প্রয়োজনীয়তা এখন সবাই বুঝতে পারছে। এ জন্য ৫০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান ব্লকের ইট উৎপাদন করছে। সরকার এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে। তাই বর্তমানে যারা মাটি পুড়িয়ে ইট করছে, তাদের পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদনে যেতে হবে। আর ব্যবসায়ীরা এই খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন, সামনে পোড়ানো ইট থাকবে না।’
শাহরিয়ার কামাল বলেন, দূষণের ফলে পৃথিবী এমন একটা জায়গায় চলে গেছে, তা থেকে উদ্ধার সম্ভব কি না, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সন্দেহ আছে। বৈশ্বিকভাবে পরিবেশ যেভাবে বিপর্যয় হচ্ছে, তাতে আর পিছু হটার সুযোগ নেই। বৈশ্বিক আবহাওয়া আরও উষ্ণ হয়ে উঠছে। বরফ গলতে শুরু করছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বাড়ছে। তিনি মনে করেন, সরকার বা বড় কোম্পানিগুলো কী করবে তার জন্য বসে থাকলে চলবে না। এখন সময় এসেছে প্রত্যেকের দায়িত্ব নেওয়ার।
কনকর্ড ওয়েস্টিন হোটেল, পুলিশ প্লাজা, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, লেকসিটি, ফ্যান্টাসি কিংডম, ফয়’স লেকসহ বিভিন্ন প্রকল্প পরিবেশবান্ধব এসব সামগ্রী ব্যবহার করেছে।
পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারে সবাইকে সচেতন করতে হবে বলে মনে করেন শাহরিয়ার কামাল। তিনি বলেন, ঢাকার ৫৮ শতাংশ বাতাস দূষণ হচ্ছে ইট পোড়ানোর কারণে। এর ফলে প্রতিবছর এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। তাই সচেতন হতে হবে এখনই। আর অপেক্ষা করা যাবে না। জলবায়ু বিপর্যয় সবার আগে নিম্নস্তরের মানুষকে আঘাত করে। তারা চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পায় না। যারা পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন করবে, তাদের কর ছাড়, কম সুদে ঋণসহ নানা সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তাহলে সবাই এ খাতে বিনিয়োগ করবে।
পরিবেশবান্ধব ইট কি সাশ্রয়ী, জানতে চেয়েছিলাম শাহরিয়ার কামালের কাছে। তিনি বলেন, একটা ব্লক পাঁচটি ইটের সমান। পাশাপাশি এর স্থায়িত্ব বেশি। সবকিছু চিন্তা করলে পুরো ভবন নির্মাণে প্রচলিত ইটের চেয়ে খরচ কম হয়। আর বাংলাদেশের মতো প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য ব্লক খুবই মানানসই।