কোভিড-১৯-এর ধাক্কা নব্য উদরনীতিবাদী অর্থনীতির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে বলে মনে করেন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস শোয়াব। এখন পুঁজিবাদের মৌলিক পরিবর্তনের সময় এসেছে। শুধু আর্থিক লাভ নয়, পুঁজিবাদকে টিকে থাকতে হলে সামাজিক, প্রাকৃতিক ও মানব পুঁজি আমলে নিতে হবে। অন্যথায় অর্থনৈতিক অসমতা শুধু বাড়তেই থাকবে এবং পরিবেশ বিপর্যয় আরও মারাত্মক হবে। তবে তিনি মনে করেন, পরিবর্তন কোনো না কোনোভাবে আসবে, এমনকি সহিংস উপায়েও হতে পারে।
কোভিড-১৯ এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন ক্লাউস শোয়াব। সে কারণে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এখন আরও সহনশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই হতে হবে। কোভিড-১৯: দ্য গ্রেট রিসেট শীর্ষক নতুন গ্রন্থে এসব কথা বলেছেন শোয়াব।
নব্য উদারনীতিবাদের সঙ্গে কোভিড-১৯-এর তীব্রতার যোগ আছে বলেই দেখতে পান শোয়াব। এটিকে তিনি পুঁজিবাদের অনিয়ন্ত্রিত রূপ হিসেবে দেখেন। বইয়ে তিনি লিখেছেন, নব্য উদারনীতিবাদের সবচেয়ে বড় সমর্থক হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেন এবং তারাই কোভিড-১৯-এ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। সে জন্যই তিনি বলছেন, ‘মহামারিতে বোঝা গেল, নব্য উদারনীতিবাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে।’
শোয়াবের কথা বিপ্লবী শোনালেও তিনি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নন, বরং তিনি পুঁজিবাদের অনিয়ন্ত্রিত রূপের বিরুদ্ধে। তিনি বলছেন, ‘আমি এখনো বিশ্বাস করি যে প্রত্যেক ব্যক্তির উদ্যোগের শক্তি প্রকৃত উন্নয়নের চালিকা শক্তি, তবে সেটা রাষ্ট্রের নয়। তাই ব্যক্তির এই শক্তি যেন চরম রূপ লাভ না করে, সে জন্য তাঁকে নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধতে হবে। রাষ্ট্রকে শক্তিশালী হয়ে এই কাজ করতে হবে। বাজার এককভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।’
বাজার, গণতন্ত্র, মানবাধিকার—এই তিনটি পাল্টা সমালোচনার মুখে প্রথাগত সমাজতন্ত্রের আকর্ষণী ক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন পুঁজিবাদের সমর্থকেরাই বলছেন, বাজারের রাশ টেনে ধরতে হবে। জোসেফ স্টিগলিৎসের মতো নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ থেকে পল ক্রুগম্যান, সবাই সে কথা বলছেন। আর পল ক্রুগম্যান তো বাজারের অদৃশ্য হাতের নীতিতে বিশ্বাস করেন না। তিনি মনে করেন, বাজার নিজে নিজে সব ঠিক করে দিতে পারে না। সেখানে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ দরকার।
মানব উন্নয়নের কথা বলছেন এঁরা। তাই মানব উন্নয়ন এখন আর শুধু অমর্ত্য সেনের মতো দার্শনিক-অর্থনীতিবিদের মতবাদ নয়,পুঁজিবাদের কেন্দ্র থেকেও মানব উন্নয়নের দাবি উঠে আসছে। ১৯৯৪ সালে ডেভিড মিলিব্যান্ড সম্পাদিত রি-ইনভেন্টিং দ্য লেফট বইতে গর্ডন ব্রাউন ‘দ্য পলিটিকস অব পটেনশিয়াল’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি সবার জন্য ‘সমান সুযোগের’ প্রশ্নটি অর্থনৈতিক যুক্তিতেই চালু রাখা প্রয়োজন, এমন মত দেন: ‘যেসব অর্থনীতি তার নাগরিকদের অন্তর্নিহিত সেরা গুণাবলি বের করে আনতে পারে না, সেসব অর্থনীতি অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়ে।’ কিন্তু সবাই সমান সুযোগ পেলে তাতে বৈষম্য এ রকম মাথাচাড়া দিতে পারে না।
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বোঝা যায়, গণতন্ত্র কোথায় যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি তাঁর ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ নেই। আর অর্থনৈতিক নীতিতে তিনি নব্য উদারনীতিবাদের পাঁড় সমর্থক।
শোয়াব বলেন, প্রথমত এই ব্যবস্থার পতন ঠেকাতে হবে, অন্যথায় অনেক কাজ ও অর্থনৈতিক শক্তি হারিয়ে যাবে। স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে, তবে তার গতিমুখও ঠিক রাখতে হবে। জার্মানির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি ডিজিটাইজেশন এগিয়ে নিতে হবে।
তাই স্বাভাবিক অবস্থায় আর ফিরে যাওয়া হচ্ছে না বলেই মনে করছেন শোয়াব। কথা হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য যেভাবে জলবায়ু বা আবহাওয়ায় প্রভাব ফেলছে, তাতে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন একসময় আমাদের জীবনধারা বদলে দেবে, এখন যেমন মহামারি বদলে দিচ্ছে। ব্যবসায়ী নেতা ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যদি পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে কিছু না করেন, তাহলে বিপ্লব হবে। ইতিহাস আমাদের সব সময় এই শিক্ষাই দেয়।