ধানের দামের সঙ্গে কমছে কৃষকের আনন্দ-উৎসবও
বোরো ধানের দাম কম, এ নিয়ে কৃষকের কষ্ট তো আছেই। কিন্তু গত আমনেও বাম্পার ফলন হয়েছিল। সেই চাল অনেক মাঝারি ও বড় কৃষক আর চালকলমালিকের কাছে রয়ে গেছে। তার কী হবে?
কোন চাল সরকারি গুদামে দেবেন, বোরো না আমন, তা নিয়ে গত বৃহস্পতিবার চাল ব্যবসায়ীরা নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, জেলায় প্রায় ছয় লাখ টন আমনের চাল রয়ে গেছে। এসব চাল বিক্রি না হলে তাঁরা কীভাবে বোরো কিনবেন? আর খাদ্য নিয়ন্ত্রক জি এম ফারুক হোসেন পাটোয়ারীর পাল্টা যুক্তি, এখনকার সংগ্রহ অভিযানের নাম ‘বোরো সংগ্রহ’। তাই চাইলেই আমনের চাল নেওয়া যাবে না। আবার আমনের চালও পুরোনো, এগুলোর আর্দ্রতা অনেক কমে গেছে। ফলে গুদামে তা বেশি দিন রাখা যাবে না। পোকা ধরবে, তখন সাংবাদিকেরা আবার লিখবেন, সরকার গরিব মানুষদের পোকায় খাওয়া নষ্ট চাল দিচ্ছে।
বৈঠকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছিলেন নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাবেক সভাপতি তৌফিকুল ইসলাম। সরকারি গুদামে কোন চাল যাবে বা যাবে না, এই বিতর্কে না ঢুকে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ব্যবসা কেমন? ধানের কেজি ১২ টাকা আর তা ভাঙিয়ে চাল করলে দাঁড়ায় ১৬ টাকা। সরকারি গুদামে তা দিচ্ছেন ৩৬ টাকায়। আপনাদের তো ব্যবসা ভালোই যাচ্ছে। জবাবে নওগাঁর এই বড় ব্যবসায়ী বললেন, ‘আগে ৪০ টাকা কেজি দরে কেনা চালের দর যে ২০ টাকা হয়ে গেল, সেই লোকসানের ভার কে বইবে? আমার ধান–চাল ছাড়াও তো জুয়েলারি ব্যবসা আছে। অনেকেই কাপড়ের–জুতার ব্যবসা করে। সবার ব্যবসায় লালবাতি জ্বলছে।’
কেন? ঈদের সময় তো ব্যবসা ভালো হওয়ার কথা। এমন প্রশ্নের জবাবে আরেক ব্যবসায়ী বললেন, শহরের মার্কেটগুলোর অবস্থা না দেখলে বোঝা যাবে না। ঈদ, পূজা, মেলা, জামাইষষ্ঠি, সাজন (শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের জামাইকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো ও নতুন পোশাক কিনে দেওয়ার অনুষ্ঠান)—সব আনন্দ ধানের মাঠে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ধানের দামের সঙ্গে কমেছে কৃষকের আনন্দ–উৎসবও।
ওই ব্যবসায়ীর কথার সত্যতা পাওয়া গেল শহরের আনন্দবাজার–গীতাঞ্জলি মার্কেটে। পাঁচতলা শীতাতপনিয়ন্ত্র্রিত এই মার্কেটের বেশির ভাগ দোকান ক্রেতাশূন্য। দোকানদার বসে ঝিমোচ্ছেন। ফ্যাশন কালেকশনের ম্যানেজার মনোয়ার হোসেন বললেন, ‘গত বছর ১২ রোজা থেকে দিনে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা করে বিক্রি করেছি। লোকজন ধান কেটে সোজা ঈদের নতুন জামা কিনতে চলে আসত। এবার ধানের দামও নেই, আমাদের বিক্রিও নেই। দুপুর পর্যন্ত বিক্রি করেছি দেড় হাজার টাকা।
>
- বেশির ভাগ দোকানে ঈদের কেনাবেচা কম
- ছোটবড় মেলা আয়োজনসহ পূজা, জামাইষষ্ঠীর আনন্দেও ভাটা
মার্কেটের সবচেয়ে বেশি কেনাবেচা চলে শিলামনি ফ্যাশনে। সেখানে জনা দশেক বিক্রয়কর্মী। বেশির ভাগ ক্রেতাই পোশাকের দাম শুনে চলে যাচ্ছেন। একটি চুমকি দেওয়া সালোয়ার–কামিজের দাম আড়াই হাজার টাকা চাইলে ক্রেতা হতাশ ভঙ্গিতে বললেন, ‘পাচ মণ ধান বেচে এই ড্রেস নিতে হবে?’
আনন্দবাজার–গীতাঞ্জলি মার্কেটের উল্টো পাশে শুভ প্লাজা, দেওয়ান মার্কেট ও কাপড়পট্টি। এরপর কিছু পথ এগোলে সোনাপট্টি এলাকা। এখানে সোনা ও গয়নার দোকানগুলোর সামনে ফল ও ইফতারি বিক্রি হচ্ছে। সেখানেই ক্রেতা বেশি। সোনার দোকানগুলো যেন খাঁ খাঁ করছে। রুমি জুয়েলার্সে গিয়ে জানা গেল, সারা দিনে তাঁরা এক ভরি গয়নাও বিক্রি করতে পারেননি।
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সাবেক সভাপতি তৌফিকুল ইসলাম জানালেন, নওগাঁ জেলায় সোনার দোকান আছে আড়াই শর ওপরে। এখানে সাধারণত দিনে গড়ে ২০০ ভরি সোনা বিক্রি হয়। বোরো ও আমন কাটার পর এক মাস গয়না বিক্রি বেড়ে দ্বিগুণ হয়। কিন্তু এবার উল্টো, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অর্ধেক বিক্রিও হচ্ছে না। কারণ ধানের দাম নেই।
শুধু ঈদের আনন্দ আর কেনাকাটায় যে ভাটা পড়েছে, তেমনটা নয়। নওগাঁ, বগুড়া, দিনাজপুর, পঞ্চগড় এলাকায় ধান কাটার পর বসে বড় বড় মেলা। সেখানে সব ধর্মের মানুষ আসে, কেনাকাটা করে। এবার বেশির ভাগ মেলা হচ্ছে না। জেলার ধামইরহাট উপজেলার শাখর–শংকরপুর মেলা, জতিবুড়ির মেলা ও করিমের মেলা এবার হচ্ছে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন আয়োজকেরা। অন্য মেলার আয়োজকদেরও খবর নেই।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক কার্যালয় ও পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকেও জানানো গেল, এবার কোনো মেলা অনুষ্ঠানের অনুমতি চেয়ে আবেদন জমা পড়েনি। সেখানকার কর্মকর্তাদের ধারণা, ধানের দাম কম থাকায় এবার বেশির ভাগ মেলা হচ্ছে না।
দেশের কৃষি খাত ও কৃষক এক বিপর্যয়ের মধ্যে আছেন বলে মনে করেন নওগাঁর ধান আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোদ বরন সাহা। তিনি বলেন, এখান থেকে উত্তরণের জন্য চালকলমালিকেরা যাতে বেশি করে ধান কিনতে পারেন, সেই সুযোগ তাঁদের দিতে হবে। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় পড়ে থাকা সরকারি–বেসরকারি খাদ্যগুদামে ধান কিনে রাখা যেতে পারে। সেখানে স্বয়ংক্রিয় ধান শুকানো ও ঝাড়াই মেশিনের মাধ্যমে পাওয়া চাল সরকার চালকলমালিকদের কাছ থেকে নিয়ে গুদামে রাখতে পারে। এতে ধানের দাম বাড়বে, কৃষকের হাতে টাকা আসবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে দেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বিবিএসের প্রক্ষেপণ হলো, ২০১৮ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার ২১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। আর ছয় বছরের ব্যবধানে নওগাঁ জেলায় দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হয়ে ৩২ শতাংশ পেরিয়ে গেছে।
স্থানীয় নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ বলছেন, বছরের পর বছর এই জেলার কৃষকেরা ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় এবং বিকল্প জীবিকা ও শিল্পকারখানা না থাকায় সেখানে দারিদ্র্য বাড়ছে। জেলার ৯০ শতাংশ জমি এখনো শুধুই কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়। শিল্প বলতে ১ হাজার ২০০ চালকল। তাও বেশির ভাগই বন্ধ। ফলে ১০ লাখ টন ধানের উদ্বৃত্ত এই জেলার অধিবাসীদের কেউ কেউ অন্য জেলায় কাজের উদ্দেশ্যেও চলে যাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সম্মানিত ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নওগাঁসহ দেশের কৃষিপ্রধান জেলাগুলোর জন্য বোরো ফসল মার খাওয়া দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনবে। বোরোর লোকসানে কৃষক আমনে উৎপাদন কমিয়ে দেন। আর কোনো এলাকার মানুষের আয় কমে গেলে সেখানকার অধিবাসীরা উৎসব ও মেলার মতো আনন্দের বিষয়গুলোতে খরচ কমিয়ে দেবে। একই সঙ্গে ধারাবাহিক অপুষ্টির শিকারও হতে পারে এখানকার মানুষ।