দেশীয় প্রতিষ্ঠান, চর্চায় বৈশ্বিক

লতিফুর রহমান ও ট্রান্সকম গ্রুপ—একে অপরের সমার্থক হয়ে আছে। শূন্য থেকে শুরু করে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নিজের মেধা, স্বকীয়তা, নৈতিকতা ও পরিশ্রম দিয়ে ট্রান্সকম গ্রুপ গড়ে তুলেছেন সদ্য প্রয়াত লতিফুর রহমান। ট্রান্সকম গ্রুপ এখন দেশের অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠী। দেশীয় স্বকীয়তার সঙ্গে গ্রুপের মধ্যে মিশে আছে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি।

ওষুধ থেকে শুরু করে খাদ্যদ্রব্য, চা, ইলেকট্রনিক পণ্য, ভোক্তাপণ্য এমনকি গণমাধ্যম ব্যবসা—যেখানেই হাত দিয়েছে ট্রান্সকম গ্রুপ, সেখানেই ‘সোনা’ ফলেছে। এ গ্রুপে এখন প্রায় ১৭ হাজার হাজার কর্মী আছেন। আর এর সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছেন আরও লাখখানেক মানুষ।

ট্রান্সকম গ্রুপের ভিত গড়ে উঠেছিল সেই ১৮৮৫ সালে, লতিফুর রহমানের দাদা খান বাহাদুর ওয়ালিউর রহমানের হাত ধরে। জন্ম কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের চিওড়া গ্রামে হলেও দাদার শৈশব কেটেছে জলপাইগুড়িতে। সেখানেই ১৮৮৫ সালে কিছু জমি কিনে চা-বাগান শুরু করেছিলেন। জলপাইগুড়িতে জন্ম হলেও লতিফুর রহমানের বাবা মুজিবুর রহমান লেখাপড়া করেন কলকাতায়। লেখাপড়া শেষ করে আসামে ফিরে সেখানকার তেজপুরে জমি কিনে চা-বাগান তৈরি করেন। তিনিও খান বাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন। তবে দেশভাগের পর সবাইকে নিয়ে তিনি ঢাকায় চলে এসেছিলেন। এরপর সিলেটে নতুন করে চা-বাগান করার পাশাপাশি শুরু করেন পাটের ব্যবসা। চাঁদপুরের ডব্লিউ রহমান জুট মিল তাঁর বাবার তৈরি পাটকল। ১৯৬৬ সালে সেখানেই শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন লতিফুর রহমান। স্বাধীনতার পর পারিবারিক পাটকলটি জাতীয়করণ করা হয়। নানা জটিলতায় চা রপ্তানিও বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীর ৫২, মতিঝিলের ঠিকানায় শুধু একটি অফিস ছিল লতিফুর রহমানের। ভাড়ায় আসবাব এনে, ঘরের পাখা খুলে অফিসে লাগিয়ে শুরু হয় নতুন করে পথচলা। 

উত্তরা ব্যাংক থেকে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তিনি (লতিফুর রহমান) ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সেই ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়ে আজকের ট্রান্সকম গ্রুপ তৈরি হয়। পরিণত হয় দেশের অন্যতম বড় শিল্প পরিবার। অবশ্য এই শিল্প পরিবারের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৮৫ সালে, চা–বাগানের ব্যবসা দিয়ে। এখন তা দিগন্ত বিস্তার করে পাখা মেলেছে ওষুধ, খাদ্য
ও পানীয়, ইলেকট্রনিক, মিডিয়াসহ নানা ব্যবসায়। ১৩৫ বছর ধরে এই পরিবার এ দেশে ব্যবসা করছে।

দেশের আরেক পুরোনো শিল্প পরিবার এ কে খান গ্রুপ। এ কে খান কোম্পানি অ্যান্ড লিমিটেডের পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান ট্রান্সকম গ্রুপের বিষয়টি মূল্যায়ন করেছেন এভাবে, ‘ট্রান্সকম গ্রুপকে লতিফুর রহমান নিজ হাতে এত দূর নিয়ে এসেছেন। নতুন ব্যবসা কীভাবে করতে হয়, তিনি তা জানেন। যখন যে ব্যবসায় নেমেছেন, তাতেই সফল হয়েছেন। নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি আমাদের কাছে শিক্ষকের মতো ছিলেন।’

বৈচিত্র্যময় উদ্যোগ
বর্তমানে ট্রান্সকম গ্রুপ ৯টি খাতে ব্যবসা পরিচালনা করছে। গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণাধীনে এখন ১৬টি কোম্পানি আছে। কোম্পানিগুলো হলো: এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, বাংলাদেশ ল্যাম্পস লিমিটেড, বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মিডিয়াস্টার লিমিটেড, মিডিয়াওয়ার্ল্ড লিমিটেড, ট্রান্সকম লিমিটেড, ট্রান্সকম বেভারেজেস লিমিটেড, ট্রান্সকম ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড, ট্রান্সকম ফুডস লিমিটেড, ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস লিমিটেড, ট্রান্সকম কনজিউমার প্রডাক্টস লিমিটেড, টি হোল্ডিং লিমিটেড, ট্রান্সক্রাফট লিমিটেড, ট্রিনকো লিমিটেড, ট্রান্সফিন লিমিটেড ও রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স লিমিটেড। এর মধ্যে কয়েকটি কোম্পানি ট্রান্সকম গ্রুপের একক মালিকানাধীন নয়; তবে বৃহত্তম শেয়ারধারী হিসেবে নিয়ন্ত্রণাধীন।

আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড পিজা হাট, কেএফসি, পেপসিকো ও ফিলিপসের এ দেশের ব্যবসায় অংশীদার এখন ট্রান্সকম গ্রুপ। দেশের শীর্ষ বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার ট্রান্সকম গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়।

ট্রান্সকম গ্রুপের আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠান এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯০ সালে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের ওষুধ ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া ও আফ্রিকার ২৬টি দেশে রপ্তানি হয়। এখানে কাজ করেন চার হাজারের বেশি কর্মী।

ট্রান্সকম গ্রুপের ১৬টি প্রতিষ্ঠানে সব মিলিয়ে ১৭ হাজার কর্মী কাজ করেন। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি ও মেধা ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠান যে গড়ে তোলা যায়, তার উদাহরণ লতিফুর রহমান। ব্যাংকের টাকা লুটপাট করে নয়, সরকারকে কর দিয়ে তিনি ব্যবসা করেছেন। দেশীয় প্রতিষ্ঠানে করপোরেট সংস্কৃতি গড়ে তোলার পেছনেও ট্রান্সকম গ্রুপের অবদান অনুকরণীয়।

অর্জন
সময়ের আবর্তনে ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তাঁর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সময়ে নানা দেশে-বিদেশে সম্মাননা পায়। লতিফুর রহমানের অন্যতম বড় অর্জন হলো ২০১২ সালের ‘অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড’। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা, সুনাম আর সততার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের নোবেল পুরস্কার হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের কোনো উদ্যোক্তার এটাই প্রথম এই ধরনের পুরস্কার পাওয়া।

২০০৯ ও ২০১৬ সালে ট্রান্সকম বেভারেজেস নির্বাচিত হয় ‘গ্লোবাল বটলার অব ইয়ার’।

সরকারের পাওনা শুল্ক–কর দেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রান্সকম গ্রুপ অন্যদের কাছে অনুসরণীয়। নিয়মিত কর দেওয়ার জন্য লতিফুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে ২০১৬-১৭ করবর্ষে ‘কর বাহাদুর’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সরকার ওই এক বছরই এই পুরস্কার দিয়েছে। ট্রান্সকম গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠান যেমন মিডিয়াস্টার লিমিটেড, মিডিয়াওয়ার্ল্ড, ট্রান্সক্রাফট লিমিটেড নিয়মিতভাবে গণমাধ্যম শ্রেণিতে প্রতিবছর শীর্ষ করদাতার তালিকায় থাকছে। এ ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও বিভিন্ন সময়ে সেরা ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠান হয়েছে। সার্বিকভাবে ট্রান্সকম গ্রুপ দেশের শীর্ষ করপোরেট কর প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছ থেকে কর কার্ড পেয়েছে ট্রান্সকম গ্রুপ।

লতিফুর রহমান ও ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে এনবিআরের আয়কর বিভাগের সাবেক সদস্য সৈয়দ আমিনুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘লতিফুর রহমান অত্যন্ত উঁচু মানের উদ্যোক্তা ছিলেন। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তিনি (লতিফুর রহমান) নৈতিক মানদণ্ড বজায় রেখে একজন আদর্শ করদাতা ছিলেন। তিনি করের হিসাব-নিকাশের বিষয়ে সব সময় স্বচ্ছ ছিলেন। একইভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোও কর প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রেখেছে। এসব প্রতিষ্ঠান সব সময় সঠিকভাবে কর দিয়েছে। এনবিআরের কাছে লতিফুর রহমান ও তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময়েই ভালো করদাতা হিসেবে বিবেচিত। এ কারণেই এনবিআর লতিফুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে কর বাহাদুর পরিবারের স্বীকৃতি দিয়েছে। ট্রান্সকম গ্রুপের অনেক প্রতিষ্ঠান সেরা করদাতা হয়েছে।’

টিকে থাকবে শতাব্দী পেরিয়ে
লতিফুর রহমান নেই। কিন্তু তাঁর তৈরি করা শিল্প গ্রুপটি আছে। তিনি সব সময় চেয়েছেন শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও টিকে থাকবে ট্রান্সকম গ্রুপ। এখন তাঁর সন্তানেরা এর দায়িত্বে। দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, লতিফুর রহমানের দীর্ঘদিনের সঙ্গী, এসিআই গ্রুপের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলা এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘লতিফুর রহমানের পরিবারের সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্ক। লতিফুর রহমানের সন্তানেরা তাঁর ব্যবসা খুব ভালোভাবে চালাবে বলে আমি মনে করি। বড় মেয়ে সিমিন হোসেন তো খুব ভালো করছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্তের চিকিৎসায় একটি ওষুধ তৈরি করে ফেলেছে। এটা তার সাফল্য। আমি আশা করি, তারা (লতিফুর রহমানের সন্তানেরা) ব্যবসা ভালো চালাবে। তবে পিতার সততা ও নৈতিকতা তাদের ধরে রাখতে হবে। এটা সহজ ব্যাপার নয়।’

এম আনিস উদ দৌলা আরও বলেন, ‘লতিফুর রহমানের ব্যবসায়িক সাফল্যের কারণ তাঁর সততা। বাংলাদেশে যেসব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান আসত, তাদের প্রথম পছন্দ ছিলেন লতিফুর রহমান। এর কারণ, বহুজাতিকেরা চাইত সৎ ব্যক্তির সঙ্গে কাজ করতে। লতিফুর রহমান দূরদর্শী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বললে বহুজাতিকেরা অভিভূত হতো। এ কারণে ফিলিপস, স্যামসাংয়ের মতো কোম্পানি লতিফুর রহমানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। লতিফুর রহমান সৎ মানুষ ছিলেন। তিনি নিজে যা বিশ্বাস করতেন, সেটা ধরে রাখা ছিল তাঁর অসাধারণ গুণ। দুটি সেরা খবরের কাগজ চালাতে তাঁকে অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে। তারপরও নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি পত্রিকা দুটি চালিয়েছেন। এটা তাঁর একটি অপূর্ব অবদান, যা আমাদের দিয়ে গেছেন।’

সবশেষে এম আনিস উদ দৌলা বললেন, ‘লতিফুর রহমান আমাদের দেশের একটি রত্ন। আমরা তাঁর অভাব খুব অনুভব করব।’