জুস–ড্রিংকসের বাজারেও আমের রাজত্ব
আমের ভরা মৌসুম টেনেটুনে দুই থেকে আড়াই মাস। এরপরও রসাল এই ফলপ্রেমীদের জিবের স্বাদ মেটাতে বাজারে আছে আমের রস বা জুস এবং পানীয় বা ড্রিংকস। ভালো চাহিদা থাকায় ধীরে ধীরে পণ্যটির বাজার বড় হচ্ছে। বর্তমানে বাজারে যত ধরনের ফলের জুস বা ড্রিংকস রয়েছে, তার মধ্যে আমেরই রাজত্ব ৯০ শতাংশের কাছাকাছি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নব্বইয়ের দশকে দেশীয় কোম্পানির হাত ধরে প্রথম বোতলজাত ফলের জুসের স্বাদ পায় বাংলাদেশের মানুষ। শুরুতে পণ্যটি জনপ্রিয় করতে কোম্পানিগুলোকে বেশ বেগ পেতে হয়। পরে অবশ্য দ্রুত বাজার বাড়ে। বর্তমানে ফলের জুস ও ড্রিংকসের বাজার দাঁড়িয়েছে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার। তার মধ্যে আমের জুস ও ড্রিংকসের বাজার ৬৩০ থেকে ৭২০ কোটি টাকার। এ বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে সাত-আটটি প্রতিষ্ঠান। আবার মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের উৎপাদিত জুসও বাজারে পাওয়া যায়। তবে আমদানি হওয়া জুসের বাজার খুবই ছোট।
বর্তমানে প্রাণ, আকিজ, সেজান, পারটেক্স, একমি, আবুল খায়ের, ট্রান্সকম ও গ্লোবের মতো শিল্পগোষ্ঠী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে জুস ও ফ্রুট ড্রিংকস উৎপাদন ও বিক্রি করে। আম ছাড়াও আনারস, পেয়ারা, আপেল, কমলা, লেবুসহ বিভিন্ন ফলের জুস ও ড্রিংকস রয়েছে কয়েকটি কোম্পানির। একসময় শুধু কাচের বোতলে জুস বিক্রি হলেও বর্তমানে প্লাস্টিকের বোতল ও ট্রেটা প্যাক বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। শহর থেকে গ্রামগঞ্জের দোকানে পাওয়া যায় পণ্যগুলো।
৯ বছর আগে দেশে শুধু জুসই বিক্রি হতো। বর্তমানে ঠিক তার উল্টো। ২০১২ সালের জুনে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিএসটিআই জুস ও ড্রিংকসের নতুন মান নির্ধারণ করে দেয়। তখন ফলের জুস বা রসে ওই ফলের অন্তত ৮৮ শতাংশ প্রাকৃতিক উপাদান (ফ্রুট পাল্প) থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। আর ফলের ড্রিংকসে বা পানীয়তে প্রাকৃতিক উপাদান থাকতে হবে অন্তত ১০ শতাংশ। আগের মান অনুযায়ী, ফলের জুসে ২৫ শতাংশ ও ড্রিংকসে ১০ শতাংশ প্রাকৃতিক উপাদান থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল। বিএসটিআইয়ের নতুন মানের কারণে একটি ছাড়া সব কটি কোম্পানি বর্তমানে ফ্রুট ড্রিংকস উৎপাদন করছে।
আমরা আমের পাল্প উৎপাদনের জন্য অ্যাসেপটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। ড্রিংকসের সঠিক মান বজায় রাখতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে প্রযুক্তিটি আনা হয়েছে। তবে সেটির জন্য ভোক্তাদের অতিরিক্ত কোনো অর্থ দিতে হয় না।
আমের জুস উৎপাদনকারী একাধিক কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, আমের মৌসুমে উত্তরবঙ্গের চুক্তিভিত্তিক কৃষক ও হাট থেকে পাকা আম সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই আম বাছাই করে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মাধ্যমে প্রথমে গরম পানিতে ধুয়ে নেওয়া হয়। তারপর আমের পাল্প তৈরি হয়। সেই পাল্পের সঙ্গে পানি, চিনি ও বিটা ক্যারোটিন মিশিয়ে ড্রিংকস তৈরি করে কাচ ও প্লাস্টিকের বোতলজাত অথবা ট্রেটাপ্যাকের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই তাদের ব্র্যান্ডের আমের ড্রিংকসে ১০-২৫ শতাংশ পাল্প ব্যবহার করে।
দেশে ফলের জুস ও ডিংকসের বাজারে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি প্রাণ জুস ও ড্রিংসের বাজারে এগিয়ে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, প্রাণের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরী নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে নরসিংদী এলাকায় শাকসবজি ও ফলমূলের চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ শুরু করেন। কিন্তু সেসব বাজারজাত করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লেন। কারণ, মৌসুমে এত বেশি পণ্য উৎপাদিত হয় যে দাম পাওয়া যায় না। তখন তিনি আনারস সুগার ক্যানে বাজারজাত শুরু করেন। এরপর তিনি জুস উৎপাদনে যান। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমের পাল্প বানানোর জন্য বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আনেন। ১৯৯২ সাল থেকে আমের জুস বাজারজাত শুরু করে প্রাণ।
শুরুর দিকে নরসিংদীর কারখানায় প্রাণের জুস তৈরি হতো। সেই জুস একটি ট্রাকে করে শ্যামপুরের গুদামে আনা হয়। সেখান থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাজারজাত হতো। তবে আমের জুস জনপ্রিয় করতে চার-পাঁচ বছর সময় লেগে যায়। আগে নন-অ্যাসেপটিক প্রযুক্তিতে পাল্প উৎপাদন করত প্রাণ। তাতে প্রিজারভেটিভ ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে তারা অ্যাসেপটিক পদ্ধতিতে পাল্প উৎপাদন করে। এতে প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয় না।
২০১৯ সালে ৬ কোটি ২০ লাখ ডলারের জুস ও ড্রিংকস রপ্তানি করে প্রাণ। পরের বছর করোনার কারণে সেটি কমে যায়। এরপরও ৫ কোটি ডলারের জুস ও ড্রিংকস রপ্তানি হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ফলের জুস ও ড্রিংকস রপ্তানি হলেও আমই বেশি।
এসব তথ্য দিয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত আমজাদ খান চৌধুরীর হাত ধরেই প্রথম দেশের বাজারে আমের জুস আসে। তবে আমের রস বোতলে ভরার বিষয়টি প্রথম দিকে ভোক্তারা বিশ্বাস করতে চাননি। দোকানদারেরাও রাখতে চাইতেন না। তখন আমরা পেপসি-ফান্টার খালি কেসে দুই–চারটা করে প্রাণের ম্যাঙ্গো জুস জোর করে দিয়ে আসতাম। এরপর একটি বিজ্ঞাপন বানানো হলো। ভোক্তারা কৌতূহলবশত দু–একবার খেয়ে দেখলেন জিনিসটি মন্দ নয়। এভাবেই ধীরে ধীরে সারা দেশে আমের জুস জনপ্রিয় হয়।
দেশে জুস ও ড্রিংকসের বাজারে নেতৃত্ব দিলেও তার তুলনায় বিদেশের বাজারেই বেশি ব্যবসা করছে প্রাণ। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানালেন, ২০১৯ সালে ৬ কোটি ২০ লাখ ডলারের জুস ও ড্রিংকস রপ্তানি করে প্রাণ। পরের বছর করোনার কারণে সেটি কমে যায়। এরপরও ৫ কোটি ডলারের জুস ও ড্রিংকস রপ্তানি হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ফলের জুস ও ড্রিংকস রপ্তানি হলেও আমই বেশি।
জুস ও ড্রিংকসের বাজারে আকিজ ফুডস ও বেভারেজের ফ্রুটিকা ব্র্যান্ডটি পরিচিত নাম। আমের পাশাপাশি কমলালেবু ও আঙুরের ড্রিংকস রয়েছে তাদের। জানতে চাইলে আকিজ ভেঞ্চারসের গ্রুপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আমের পাল্প উৎপাদনের জন্য অ্যাসেপটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। ড্রিংকসের সঠিক মান বজায় রাখতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে প্রযুক্তিটি আনা হয়েছে। তবে সেটির জন্য ভোক্তাদের অতিরিক্ত কোনো অর্থ দিতে হয় না।’