প্রায় ছয় বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দরে মরিচারোধী লোহার পুরোনো পণ্যে তেজস্ক্রিয় পদার্থ শনাক্ত হয়েছিল। এই ঘটনার পর এ পর্যন্ত বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানির আরও কয়েকটি চালানে তেজস্ক্রিয় পদার্থ শনাক্ত হয়। এর মধ্যে তিনটি চালানে পাওয়া তেজস্ক্রিয় পদার্থ বন্দর থেকে সরানো হয়নি।
প্রথম শনাক্ত হওয়া তেজস্ক্রিয় পদার্থটি বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় সিপিআর ফটকের পাশে ‘মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প’ কার্যালয়ের পাশে রাখা হয়েছে। কনটেইনারের ভেতর তেজস্ক্রিয় পদার্থটি একটি বাক্সে রেখে চত্বরটির চারদিকে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। বাকি দুটি কনটেইনারও সেখানে রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর পর্ষদের সদস্য মো. জাফর আলম প্রথম আলোকে বলেন, তেজস্ক্রিয় পদার্থটি বেশি দিন বন্দরে রাখা উচিত নয়। এটি বিধি মোতাবেক যথোপযুক্ত স্থানে সরিয়ে নেওয়া উচিত।
তেজস্ক্রিয় পদার্থ উদ্ধারের পর বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কনটেইনারের ভেতরে রাখা হলেও তেজস্ক্রিয় পদার্থ রাখার জন্য মোটেই নিরাপদ স্থান নয় বন্দর চত্বর। কারণ, কোনো কারণে এটির সংস্পর্শে এলে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। আবার পানিতে ভিজে গেলেও পানি দূষিত হয়ে পড়বে। নিয়মানুযায়ী, ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সাভারের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইউনিটে সংরক্ষণ করার কথা।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তেজস্ক্রিয় পদার্থ মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এটি যেখানে রাখা হবে, সেখানে ভালোভাবে শিল্ডিং করে রাখতে হবে। এটির কাছাকাছি যাতে মানুষের চলাচল না থাকে, সেটিও নিশ্চিত করা উচিত।
কেন সরানো হচ্ছে না?
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভারতে রপ্তানির পথে শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে পুরোনো ইস্পাত পণ্যে প্রথমবার তেজস্ক্রিয় পদার্থটি শনাক্ত হয়। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল ওই ঘটনার পর তা চট্টগ্রামে ফেরত পাঠিয়ে দেয় শ্রীলঙ্কার বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রায় আট মাস পর ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি একটি প্রকল্পের কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও যুক্তরাষ্ট্রের ২৩ বিজ্ঞানী কনটেইনারটি থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থটি আলাদা করেন। এই পদার্থ সরিয়ে নেওয়ার জন্য পরমাণু শক্তি কমিশনকে চিঠি দেয় বন্দর।
বন্দরের চিঠি পাওয়ার পর পরমাণু শক্তি কমিশন তেজস্ক্রিয় পদার্থটি সরিয়ে নিতে ২২ লাখ টাকা খরচ হবে বলে ওই সময় বন্দরকে জানায়। এ নিয়ে বন্দরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কমিশনের কর্মকর্তাদের একাধিক বৈঠকে ঠিক হয়, যে প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি পণ্যে তেজস্ক্রিয় বস্তুটি শনাক্ত হয়েছে, সেই রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে ব্যয় মেটাতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীতাকুণ্ডে অবস্থিত রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানটি এখন দেউলিয়া হয়ে গেছে।
বন্দরে যত তেজস্ক্রিয় পদার্থ
ছয় বছর আগে শনাক্ত হওয়া প্রথম তেজস্ক্রিয় পদার্থটির নাম ‘রেডিয়াম বেরিলিয়াম’। শিল্পকারখানায় মান নিয়ন্ত্রণের কাজে এর ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের। তেজস্ক্রিয়তাযুক্ত বস্তু থেকে গামা রশ্মি ও নিউট্রন কণা নির্গত হয়। এর সক্রিয়তার মাত্রা ৫ থেকে ১০ মিলিকুরি (তেজস্ক্রিয়তার একক)। পদার্থটি থেকে ঘণ্টায় ১২ হাজার মাইক্রোসিয়েভার্টস (তেজস্ক্রিয়তা থেকে যে বিকিরণ হয়, তার একক) বিকিরণ হয়।
তেজস্ক্রিয় পদার্থের দ্বিতীয় চালানটি শনাক্ত হয় ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট। সিটাডেল গ্লোবাল করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান চীনে রপ্তানির সময় জিংক অক্সাইডের একটি চালানে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয়। কনটেইনারটির বাইরে থেকে প্রাথমিক পরীক্ষায় তাতে ঘণ্টায় ৬ দশমিক ২৪ মাইক্রোসিয়েভার্টস পাওয়া গেছে। এটি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি। এরপর ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানির সময় পুরোনো লোহার পণ্যে আরেকটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ শনাক্ত হয়। এ দুটোতে তেজস্ক্রিয় মৌলটি হলো ‘সিজিয়াম ১৩৭’।
এই তিনটি ছাড়াও আরেকটি রপ্তানি চালানে তেজস্ক্রিয় পদার্থ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মিরসরাইয়ে একটি ইস্পাত প্রতিষ্ঠানের কারখানায় সর্বশেষ তেজস্ক্রিয় পদার্থটি রাখা হয়েছে। সেটি সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
পরমাণু শক্তি কেন্দ্র চট্টগ্রামের পরিচালক শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মেগাপোর্ট প্রকল্পের পরিচালনা পদ্ধতি কার্যকর হলে কোন অংশে কার দায়দায়িত্ব, তা উল্লেখ থাকবে। তখন আর সংরক্ষণ ও স্থানান্তর নিয়ে জটিলতা থাকবে না।