চীনের বেসরকারি কোম্পানি কি আদৌ বেসরকারি
অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক
চীনের বেসরকারি কোম্পানিগুলো আদৌ বেসরকারি, নাকি ছায়া সরকারি প্রতিষ্ঠান—এই সন্দেহ অনেকেরই আছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো হরহামেশাই বলেন, হুয়াওয়ে চীনা সরকারের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করে। সে জন্য ফাইভ-জি প্রযুক্তির অবকাঠামো নির্মাণে হুয়াওয়েকে অংশগ্রহণ করতে দিচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। একই পথে হাঁটছে যুক্তরাজ্যসহ আরও অনেক উন্নত দেশ।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সম্প্রতি ‘অপিনিয়ন অন স্ট্রেনদেনিং দ্য ইউনাইটেড ফ্রন্ট ওয়ার্ক অব দ্য প্রাইভেট ইকোনমি ইন দ্য নিউ এরা’ শীর্ষক এক নথি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, চীনা বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে আরও বেশি বেশি সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিল রেখে কাজ করতে হবে। প্রকাশিত এই নথি ট্রাম্পের সন্দেহকে সত্য প্রমাণ করেছে।
চীনে কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে বেসরকারীকরণ ঘটেনি। সেখানে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটলেও মালিকানার অধিকারের ব্যাপারটা পরিষ্কার করা হয়নি।
পাঁচ হাজার শব্দের এই নথিতে বেসরকারি খাতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সরকার ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বিত ফ্রন্ট গড়ে তোলার লক্ষ্যে এটি প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। মোদ্দা কথা, বেসরকারি খাতের ওপর কমিউনিস্ট পার্টির কর্তৃত্ব বাড়ানো।
কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত চীনে বেসরকারি খাতেরও বিকাশ ঘটেছে। ১৯৭৮ সালের পর দেশটি অর্থনীতির দ্বার খুলে দিতে শুরু করে। বেসরকারি ও বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটে তখন।
মিনঝিন পি নামের এক চীনা লেখক ‘চায়নাস ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, চীনে কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে বেসরকারীকরণ ঘটেনি। সেখানে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটলেও মালিকানার অধিকারের ব্যাপারটা পরিষ্কার করা হয়নি। ফলে যারা শাসন করে, তারা সমাজের সম্পদ আহরণে চূড়ান্ত সুযোগ পেয়েছে। অর্থাৎ চীনে মালিকানার অধিকার আর নিয়ন্ত্রণের অধিকারের মধ্যে সীমারেখা টানা হয়েছে। আর যেখানে মালিকানার ব্যাপারটা অনিশ্চিত, সেখানে নিয়ন্ত্রণই মুখ্য ব্যাপার। এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেই চীনা সরকার এদের দিয়ে নানা ধরনের উদ্দেশ্য হাসিল করে বলে এখন জানা যাচ্ছে। প্রযুক্তি বিক্রি করে অন্য দেশের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই তারা করছে বলে অভিযোগ।
বেসরকারি খাতের কর্মীদের সরকারি নীতি ও আদর্শের ওপর কোর্স করানো হয়। পাশাপাশি চীনা সরকার বেসরকারি কোম্পানিতে ভর্তুকিও দিয়ে থাকে। চীনা জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশের সমপরিমাণ সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে।
চীনের একদলীয় ব্যবস্থায় রাজনৈতিক অভিজাত ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগসাজশটা একদম পরিষ্কার বলে মনে করেন মিনঝিন পি। এখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকলে তা দ্রুতই বিপুল সম্পদে পরিণত হতে পারে। তবে বেসরকারি খাতে অংশীদার না থাকলে এই যোগসাজশের রূপান্তর ঘটে না। আর সে কারণে দেশটিতে ব্যাপক দুর্নীতিও হচ্ছে। দুর্নীতির রাশ টানতে প্রেসিডেন্টে সি চিন পিং রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, চীনের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। ব্যবসায়িক কার্যক্রমে সরাসরি সরকারি কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ থাকে। বেসরকারি খাতের কর্মীদের সরকারি নীতি ও আদর্শের ওপর কোর্স করানো হয়। পাশাপাশি চীনা সরকার বেসরকারি কোম্পানিতে ভর্তুকিও দিয়ে থাকে। চীনা জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশের সমপরিমাণ সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) বা তার আগে গ্যাট গঠনের ভিত্তি ছিল এই যে সরকার ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এক নয়। তারা আলাদা। ফলে ডব্লিউটিওর বিধানের কার্যকর ও মসৃণ বাস্তবায়নের জন্য সরকার ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যকার বিভাজনের নীতি অক্ষরে অক্ষরে পালিত হতে হবে। কিন্তু চীন ঠিক সেখানে বিচ্যুতি ঘটিয়েছে এবং সফলও হয়েছে।
এ অবস্থায় বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে চীনা কোম্পানিগুলোকে অন্য দেশের কোম্পানির সঙ্গে এক করে দেখা চলবে না বলে ডিপ্লোম্যাটের ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে। সবাইকে এক জায়গায় নিয়ে আসা দরকার। চীনসহ সবার সুবিধা নিশ্চিত করা গেলেই এই বাণিজ্যব্যবস্থা টেকসই হবে।