চালডালে জীবনগাথা
আমার ছোটবেলার বন্ধু ওয়াসিম আলীম বাংলাদেশে পড়াশোনা করে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে একটা বিলিয়ন ডলার কোম্পানিতে কাজ করছিলেন। হঠাৎ একদিন বললেন, দেশের জন্য কিছু করতে চান। নিজেরাই কিছু করা যায় কি না, আমাকে আইডিয়া দিতে বললেন। একসময় ওয়াসিম দেশে এলেন। আমাদের আরেক বন্ধু তেজশ বিশ্বনাথও যুক্ত হলেন। তিনজনেরই ব্যবসা করার ইচ্ছা। তবে কীভাবে শুরু করব, কী দিয়ে শুরু করব, কিসের ব্যবসা করব—কিছুই ঠিক নেই।
তিন বন্ধ মিলে অনেক পরিকল্পনার পর কঠিন একটি ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেটি হচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যা যা প্রয়োজন, তা আমরা তাঁদের ঘরে পৌঁছে দেব। ২০১৩ সালে আমি নিজেই বনানীর বাসার পাশে এক দোকান থেকে কিছু মুদিপণ্য বাসায় এনে ছবি তুলে ওয়েবসাইটে দিতে শুরু করলাম। সে বছরের ২ জুলাই প্রথম ক্রয়াদেশ পেলাম। তখন আমি নিজেই সেই পণ্য ডেলিভারি করতাম। এভাবে ধীরে ধীরে গুদাম ভাড়া নিতে হলো। কর্মীর সংখ্যা বাড়তে থাকল।
আমরা যখন শুরু করলাম, তখন অনলাইন দোকান মানুষের কাছে পরিচিত নয়, তার ওপর বাসার কাছের মুদিদোকান থেকে যে পণ্য পাওয়া যায়, সেটি ঘরে বসে অনলাইনে কেনার কথা তো কেউ চিন্তাই করতে পারতেন না! সবার কাছেই মনে হলো, এটা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু আমরা তখন নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখে ফেলেছি।
শুরু হলো একটা ভালো নামের খোঁজ। মাথায় তখন নানা ধরনের নাম ঘুরপাক খাচ্ছে, এ–বাজার ও–বাজার ডটকম নিয়ে ভাবছি, কিন্তু কোনোভাবেই মন ভরছিল না। এমন একটা নাম খুঁজছিলাম, যেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। ভাবতে ভাবতেই গেল বেশ কয়েক দিন।
একদিন আমি রিকশায় করে বাজার করতে যাচ্ছি। রিকশাচালক বলে বসলেন, ‘মামা, চালডালের দাম বেড়েছে, আমাকে ১০ টাকা বাড়াইয়া দিয়েন।’ আমার মাথায় তখনই ঢুকে গেল, এই নামটাই সেরা। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু ওয়াসিমকে জানালাম। আমাদের উদ্যোগটির নাম হয়ে গেল চালডাল ডটকম।
আমার ব্যক্তি ও যন্ত্রজীবন
শৈশব কেটেছে ঢাকায়। সব সময় নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ভালোবাসি। এমনকি বাজারে কোনো নতুন ফোন এলে সেটির ফিচারগুলো দেখি, কীভাবে এই ফোনের মধ্যে চালডাল ডটকমের অ্যাপটি আরও সহজভাবে নকশা করে ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছানো যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকি। সব সময় নিজেকে হালনাগাদ রাখাটা জরুরি বলে মনে করি।
কলেজ পেরিয়ে আমি ভর্তি হয়েছিলাম নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে। পড়াশোনা করেছি বিপণন নিয়ে। তখন থেকেই ভিন্ন কিছু করার ইচ্ছা ছিল। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যোগ দিলাম একটি বেসরকারি ব্যাংকে। তারপর পোশাক কারখানায় চাকরি করেছি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা সেখানে ভালোভাবেই কাজে লাগছিল। দুই বছর পোশাক কারখানায় চাকরি করলাম। সে সময় আমার মা অসুস্থ হলেন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে যেতে হবে ভারতে। থাকতেও হবে দু-তিন মাস। অফিস এত দিন ছুটি দিতে রাজি হলো না। তখনই চাকরিটা ছেড়েই দিলাম।
একনজরে
চালডাল ডটকম
প্রতিষ্ঠা
২০১৩ সাল
প্রতিষ্ঠাতা
জিয়া আশরাফ, ওয়াসিম আলীম, তেজাস বিশ্বনাথ
কর্মী
২,৫২২
কার্যক্রম
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও যশোর। কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চালডাল ই-ভাউচার কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে
ওয়্যারহাউস
ঢাকায় ১৯টি, নারায়ণগঞ্জে ২টি, চট্টগ্রামে ৩টি এবং যশোরে ১টি
ক্রয়াদেশ
প্রতিদিন ১০-১২ হাজার
বিনিয়োগ
এখন পর্যন্ত চালডাল প্রায় ২ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার দেশি ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ পেয়েছে
আমার বাবা বাংলা চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় নায়ক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জল। অনেকেই প্রশ্ন করেন, বাবার পথ ধরে আমিও কেন রুপালি জগতে নাম লেখালাম না? নায়ক আমি কখনোই হতে চাইনি। বাবাও কিছু চাপিয়ে দেননি। বাবা শুধু পর্দার নায়ক নন, আমার কাছে সত্যিকারের নায়ক, আমার শিক্ষক। সব সময় তিনি পথ দেখিয়েছেন। বলতেন, পড়াশোনা শেষ করে যেটা ভালো লাগে, সেটাই করবে। এই যে সততার সঙ্গে ব্যবসা করছি, এর দীক্ষাটা বাবাই দিয়েছেন। আমার স্ত্রী তানজিনা ফেরদৌস, মেয়ে জুনেহেরা নিয়ে আমার পরিবার।
আমাদের চ্যালেঞ্জ
ব্যবসায় প্রতিদিনই নানা রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। ক্রেতা কোনো পণ্যের সমস্যার কথা জানালে আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেটি বদলে দিই। এমনও দেখা গেছে, মাছ রান্না হয়ে যাওয়ার পর আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। আমরা সেই মাছও বদলে দিয়েছি। এমন চ্যালেঞ্জ প্রতিদিনই নিতে হয়। তা ছাড়া আমাদের আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ, সঠিক সময়ে পণ্য পৌঁছে দেওয়া।
যাত্রা শুরুর পর এখন পর্যন্ত চালডাল প্রায় ২ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার দেশি ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ পেয়েছে, যা দিয়ে সারা দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরে আমাদের কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। চালডালের নতুন এ বিনিয়োগে প্রধান বিনিয়োগকারী লন্ডনভিত্তিক আর্থিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওয়াইজের সহপ্রতিষ্ঠাতা টাভেট হিনরিকাস, তরুণ প্রতিভাবানদের সহায়তাকারী প্ল্যাটফর্ম টপিকার মুখ্য পণ্য কর্মকর্তা স্টেন টামকিভি ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এক্সপ্লোরেশন ক্যাপিটাল। এর সঙ্গে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশের মীর গ্রুপ। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর চালডাল যুক্তরাষ্ট্রের ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠান ওয়াই কম্বিনেটর ও ফাইভ হান্ড্রেড স্টার্টআপের সহায়তা পেয়েছে। নতুন উদ্যোগ হিসেবে স্টার্টআপ বাংলাদেশের বিনিয়োগ পেয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর চালডাল ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ও আইডিএলসিরও বিনিয়োগ পেয়েছে।
বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও যশোরে চালডালের ২৫টি পণ্যগুদাম আছে। এ ছাড়া কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি পণ্যগুদাম ও যমুনা সেতুর রেলওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের আবাসিক এলাকায় সুপারশপ রয়েছে। প্রতিদিন আমরা ১০ থেকে ১২ হাজার অর্ডারের বিপরীতে পণ্য ডেলিভারি করে থাকি। এ বছরে মধ্যেই দেশের অন্তত ১৫টি নতুন শহরে ৫০টির বেশি পণ্যগুদাম স্থাপনের পরিকল্পনা আছে আমাদের। আশা করছি শিগগিরই ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও যশোর ছাড়িয়ে সারা দেশে সেবা পৌঁছে দিতে পারব।
করোনাকালের চালডাল
করোনাকালের শুরু দিকে মহামারি নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছিল অনেক। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ফলে হঠাৎ অনলাইনে নিত্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। করোনার আগে চালডাল প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ক্রয়াদেশ পেত। করোনা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি ১৬ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তখন ৯টি ওয়্যারহাউস থেকে পুরো ঢাকা শহরে পণ্য সরবরাহ করা হতো। বাড়তি চাহিদা মেটাতে আমরা দ্রুত ওয়্যারহাউস বৃদ্ধি করি।
করোনার শুরুতে মানবসম্পদ নিয়েও চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। কারণ, অনেক পণ্য ডেলিভারি নির্বাহী চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন। অবস্থা এমন হয়েছিল যে ক্রেতাদের সময়মতো পণ্য পৌঁছে দিতে আমাদের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপকেরাও কাজে লেগে পড়েছিলেন।
আগলে রাখা
ই-কমার্স নিয়ে বর্তমানে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। নেতিবাচক উদাহরণ তৈরি হয়েছে অনেকগুলো। এই ঝড় থেকে আমরা চালডালকে আগলে রাখতে পেরেছি। শুরু থেকেই চালডাল ডটকম গ্রাহকদের সঠিক পণ্য, দ্রুত ডেলিভারি প্রদান ও রিটার্ন সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। গ্রাহকদের পণ্য ও সেবার মান উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। ভবিষ্যতে আরও ভালো ও সহজতর সেবা দিতে কাজ চলছে।
এককথায় বলতে গেলে চালডাল ডটকম আর আমি একই সুতায় গাঁথা। ফলে নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা মানে চালডালকে নিয়েই স্বপ্ন দেখা। সেই স্বপ্ন থেকেই বলতে চাই, চালডাল ডটকম ই-কমার্স সাইটগুলোর রোল মডেল হিসেবে দাঁড়াতে চায়।
● জিয়া আশরাফ: প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা, চালডাল ডটকম