চট্টগ্রামে শুরু, প্রসার সিলেটে
ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশের বর্তমান ভূখণ্ডের মধ্যে চট্টগ্রামেই প্রথম চা উৎপাদন শুরু হয়। ১৮৪৩ সালে চট্টগ্রাম ক্লাব ও আশপাশের পাহাড়ি এলাকার ‘পাইওনিয়ার’ বাগানের পাতা থেকে এ চা বানানো হয়। পরীক্ষামূলক এ বাগানে আবাদ শুরু হয় ১৮৪০ সালে। অর্থ্যাৎ চারা রোপণের তিন বছরের মাথায় চা–গাছের পাতা থেকে চা তৈরি হয়।
১৮৭৩ সালে বাংলায় চা চাষবিষয়ক তৎকালীন কৃষি বিভাগের এক প্রতিবেদনে এ তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের কাছে ওই বছরের ২৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে এ প্রতিবেদন পাঠানো হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে আসামে পরীক্ষামূলক প্রথম চা তৈরির ছয় বছরের মাথায় চট্টগ্রামের বাগান থেকে চা তৈরি হয়।
চট্টগ্রামে শুরু
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৮৪০ সালে তৎকালীন কালেক্টর স্কোনস আসাম থেকে চায়ের বীজ এবং কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে তিনটি চায়না চারা সংগ্রহ করেন। এসব চারা ও বীজ পাইওনিয়ার বাগানে রোপণ করেন তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমান বাংলাদেশ অংশে প্রথম চা চাষের শুরুটা এ বাগান দিয়েই।
চট্টগ্রাম ক্লাব প্রতিষ্ঠার আগপর্যন্ত এ বাগানে চা উৎপাদিত হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ১৮৭২ সালে পাইওনিয়ার বাগানের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, সে বছর ৬ হাজার ৪০০ পাউন্ড (২ হাজার ৮৮০ কেজি) চা তৈরি হয়। সে সময় বাগানটির ১০ একরে পরিপক্ক চা–গাছ এবং তিন একরে অপরিপক্ক চা–গাছ ছিল। সব মিলিয়ে ওই বছর চট্টগ্রামে ১৩টি বাগানে ১ লাখ ৯৮ হাজার পাউন্ড চা তৈরি হয়।
১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম ক্লাবে এখন সভাপতির দায়িত্বে আছেন পেডরোলো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদের খান। যিনি দুই দশক আগে চা চাষে যুক্ত হয়ে হেক্টরপ্রতি ফলনে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন। নাদের খান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাবের চারদিকে যেসব পাহাড় রয়েছে, সেই সময় তা ছিল চা–বাগান।
বর্তমান ক্লাবটি ছিল পাইওনিয়ার বাগানের ব্যবস্থাপকের বাসা। এটিই ব্রিটিশ ভারতের বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রথম বাগান। তবে শহর বড় হতে থাকলে ধীরে ধীরে এ বাগান বিলুপ্ত হয়। আর চারা রোপণের তিন বছরের মাথায় চা–পাতা দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে চা তৈরির তথ্যটি ঠিক। তবে পরিমাণে খুব বেশি হওয়ার কথা নয়।
সম্প্রসারণ সিলেটে
চট্টগ্রামে প্রথম চাষ শুরু হলেও ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশ অংশে বাণিজ্যিকভিত্তিতে প্রথম চা চাষ শুরু হয় সিলেটে। আবার চা চাষের সম্প্রসারণও হয়েছে সেখানে। চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৫৪ সালে সিলেটে মালনীছড়া বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ‘আসাম ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারস, সিলেট’–এ বলা হয়, সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয় ১৮৫৭ সালে।
বর্তমানে দেশে ১৬৭টি চা–বাগানের ১৩৫টিই বৃহত্তর সিলেটে। চট্টগ্রামে বাগান রয়েছে ২১টি। চা সম্প্রসারণের তালিকায় এখন যুক্ত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার সমতল এলাকাও। মোট উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ আসছে সমতল থেকে।
সেরা চা কোথায়
শুরুতে চট্টগ্রামে চা চাষ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম বলে চা চাষ সম্প্রসারণেও শঙ্কা ছিল। অবহেলার কারণে অনেক চা–বাগান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এরপরও চট্টগ্রামের উৎপাদিত চায়ের মান স্বীকৃতি দিয়েছিল বিশ্বখ্যাত চা কোম্পানি টুইনিং।
১৮৭৩ সালে চট্টগ্রামের কৃষি বিভাগ থেকে ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, পাইওনিয়ার বাগানের চায়ের নমুনা ১৮৬১ সালে লন্ডনে পাঠানো হয়। পরে লন্ডনের মেসার্স টুইনিং অ্যান্ড কোম্পানি ওই নমুনা পরীক্ষা করে ‘এ ওয়ান’ ক্যাটাগরি, অর্থাৎ খুবই ভালো বলে উল্লেখ করে। ১৮৬১ সালের ১ জুলাই দেওয়া ওই সনদে চায়ের চমৎকার স্বাদ ও পানীয়ের রং উজ্জ্বল বলে উল্লেখ করা হয়।
এ স্বীকৃতির ১৬০ বছর পর আবারও স্বীকৃতি পেয়েছে চট্টগ্রামের চা। ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ নিলাম মৌসুমে (সাধারণত দেশে প্রতিবছর মে মাস থেকে পরের ১১ মাস চায়ের আন্তর্জাতিক নিলাম হয়) চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ব্র্যাকের কৈয়াছড়া ডলু বাগানের চা দেশের বাগানগুলোর মধ্যে গড়ে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ এ বাগানের চায়ের গড় মান ভালো। একরপ্রতি সর্বোচ্চ ফলনেও বছর তিনেক আগে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ফটিকছড়ির হালদা ভ্যালী চা বাগান। ২০১৭ সালে হালদা ভ্যালীতে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ছিল ৩ হাজার ৭১৭ কেজি। সে সময় দেশের অন্য চা–বাগানে গড় উৎপাদন ছিল হেক্টরপ্রতি ১ হাজার ৪৭৭ কেজি।