গড়ে উঠছে নতুন উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা
ধীরে ধীরে হলেও নতুন উদ্যোগ ও উদ্যোক্তাদের ঘিরে দেশে একটি ইকোসিস্টেম গড়ে উঠছে। ২০১৯ সালজুড়ে এই সিস্টেমের বেশ কিছুটা দৃশ্যমান হয়েছে। ২০১৯ সালেই শুধু প্রতিযোগিতানির্ভর স্টার্টআপ সংস্কৃতির বাইরে যেতে শুরু করেছে স্টার্টআপগুলো। অনেক বেশি
দৃশ্যমান হয়েছে সরকারের উদ্যোগও। বেসরকারি উদ্যোগগুলোও কেবল প্রতিযোগিতা বা পুরস্কারের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি।
চলতি বছরের বাজেটে স্টার্টআপদের জন্য ১০০ কোটি টাকার আলাদা বরাদ্দ রাখা হলেও সেটি কেমন করে উদ্যোক্তাদের কাছে পৌঁছানো হবে, তার কোনো সুরাহা হয়নি। অন্যদিকে ভেঞ্চার নীতিমালার পরিবর্তন না করে বিডি ভেঞ্চার লিমিটেড ও আইডিএলসির তহবিল গঠনকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সরকারি মালিকানাধীন স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডকেও মন্ত্রিপরিষদ নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। এই কোম্পানি স্টার্টআপ উদ্যোগে সিড ও গ্রোথ পর্যায়ে যথাক্রমে এক ও পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবে। তবে সরকারের আইসিটি বিভাগে বাস্তবায়নাধীন আইডিয়া প্রকল্পের আওতায় অনুরূপ বিনিয়োগের বিধান থাকলেও ২০১৬ সাল থেকে উক্ত প্রকল্প থেকে কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো সহায়তা পায়নি। এ বছর শিক্ষার্থীদের ২০টি উদ্যোগকে “স্টুডেন্ট টু স্টার্টআপ”-এর আওতায় ১০ লাখ টাকা করে মোট ২ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা বিশেষ করে অফিস, ইন্টারনেট ও সভাকক্ষের সুবিধা দেওয়ার রেওয়াজ বেড়েছে এবং তা ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের আইডিয়া প্রকল্পের আওতায় ৪০টি স্টার্টআপকে ঢাকার আগারগাঁওয়ের আইসিটি টাওয়ারে কো-ওয়ার্কিং স্পেসে কাজের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে এ বছর বড় আকারে চালু হয়েছে টাইগার চ্যালেঞ্জ। বিশ্বখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) সহায়তায় প্রায় ১৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ সুবিধার এই চ্যালেঞ্জের আয়োজক বাংলাদেশের টাইগার আইটি। বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক দুই পর্বের এই চ্যালেঞ্জে মোট ৬টি প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত হয়েছে। টেলিকম প্রতিষ্ঠান রবির আর-ভেঞ্চার কার্যক্রম চলতি বছরে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয় এবং চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত ৫টি স্টার্টআপকে মোট চার কোটি টাকার বিনিয়োগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অপর টেলিকম প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের উদ্যোক্তা পরিচর্যা কেন্দ্র জিপি এক্সিলারেটর চলতি বছরে সহস্রাধিক উদ্যোক্তার মধ্য থেকে ৯টি স্টার্টআপকে তাদের এক্সিলারেটর প্রোগ্রামের আওতায় সাড়ে চার মাসের নিবিড় পরিচর্যার জন্য নির্বাচন করেছে। দেশীয় স্টার্টআপে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হয়েছে দেশীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠান। দেশীয় এনজেল বিনিয়োগকারীদের নেটওয়ার্ককে এ বছর সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে এবং বছর শেষে নারী এনজেল বিনিয়োগকারীদের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠার কথা জানা গেছে।
দেশীয় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি দেশীয় স্টার্টআপে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ চলতি বছর আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছর বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শপ-আপ, সহজ ডট কম, ই-কুরিয়ার, সাজগোজ ডট কম, যাত্রিক ইত্যাদি। পাঠাও-এর এনজেল বিনিয়োগকারী মাত্র চার বছরে ১৫ গুণ আর্থিক লাভে বিনিয়োগ উঠিয়ে নিয়েছেন। তবে কয়েক শ কর্মী চাকরিচ্যুত হওয়ায় এ বছর শিরোনাম হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় স্টার্টআপ পাঠাও। সময়মতো বিনিয়োগ নিশ্চিত না হওয়ায় কিছুটা হলেও বিপদে পড়েছে দেশীয় খাবার সরবরাহের স্টার্টআপ হাংরি নাকি।
স্টার্টআপ নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ক্ষেত্রে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনোভেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ বিভাগের স্নাতক কার্যক্রম আরও বিকশিত হয়েছে। চলতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের আশুলিয়া ক্যাম্পাসে ইনোভেশন ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেছে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনোভেশন, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ সেন্টারের যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ছাড়াও উদ্যোক্তা বিকশিত করার স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগসমূহের কর্মকাণ্ড চলতি বছরে আরও বেড়েছে। ফেসবুকভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ চলতি বছরেও নবীন উদ্যোক্তাদের সম্মাননা জানানো অব্যাহত রেখেছে।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও স্টার্টআপ মার্জারের একটি সংবাদ বছরের শেষের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পাঠাও এবং শিওর ক্যাশের একীভূত হওয়ার সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও সংশ্লিষ্ট মহলের চূড়ান্ত কোনো সম্মতি এখনো জানা যায়নি।
স্টার্টআপ সংস্কৃতির এই বিকাশের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে বাংলাদেশ আট ঘর এগিয়ে ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮তম হয়েছে। এটিই প্রমাণ করে, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের কতটা বৈরী পরিবেশের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
তারপরও তাদের প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাওয়া স্বপ্নের সূর্যটাকে জিইয়ে রাখে।