গ্রেপ্তার হতে দেশে ফিরছেন না পি কে হালদার
তিনি লুট করেছেন। চেয়েছিলেন দেশে ফিরে হয়রানি ছাড়া ব্যবসা পরিচালনার। আবার লুটের টাকা ফেরতও দিতে চেয়েছিলেন। তবে আদালতের নির্দেশ, বিমান থেকে নামামাত্রই গ্রেপ্তার। এখন তিনিও আসবেন না। তবে গ্রেপ্তার–আতঙ্কে নয়, কারণ বলেছেন ‘জ্বর’, তাঁর ভাষায় যা করোনার লক্ষণ।
তিনি আর কেউ নন, আর্থিক খাতের বিপুল অর্থের সুবিধাভোগী আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালে তিনি প্রতিষ্ঠান দখল করে লুট করেন। প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থেকে এমন অপকর্মের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।
গত শুক্রবার রাতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। কাল রোববার আদালতে বিষয়টি উপস্থাপন করবেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির আইনজীবীরা।
চিঠিতে পি কে হালদার লিখেছেন, তিনি জ্বরে ভুগছেন এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা করোনাভাইরাসের উপসর্গ এবং এ পরিস্থিতিতে ভ্রমণ করতে আগ্রহী নন। এ পরিস্থিতিতে তাঁর পক্ষে ভ্রমণ করা সম্ভব নয় বলেও জানিয়েছেন। শারীরিকভাবে সুস্থ হলে ২৫ অক্টোবরের পরিবর্তে নতুন ভ্রমণ তারিখ ও সময় জানাবেন বলে তিনি চিঠিতে লিখেছেন।
চিঠিতে তিনি এ–ও লিখেছেন, দেশে ফিরতে চাওয়া নিয়ে তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত যে আদেশ দিয়েছেন, তা তিনি পাননি।
জানা যায়, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালে পি কে হালদার বেনামে কমপক্ষে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেন। এরপর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লুট করেন। এর বাইরে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেও বেনামে টাকা বের করেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। তবে আলোচনায় আসার পরই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান পি কে হালদার।
এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং গ্রাহকের আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারছিল না। এ কারণে একাধিক গ্রাহক আদালতের শরণাপন্ন হন। পরে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে নিয়োগ দেন। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ পরে দায়িত্ব থেকে ইস্তফা নিলে হাইকোর্ট গত মার্চে প্রতিষ্ঠাটির চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন সাবেক সচিব নজরুল ইসলাম খানকে। একপর্যায়ে পি কে হালদার দেশে ফিরে অর্থ ফেরত দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ওই আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের জিম্মায় পি কে হালদারকে দেশে ফেরত আসার সুযোগ দেওয়ার আবেদন করে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং।
চিঠিতে বিভিন্ন নামে টাকা বের করে নেওয়ার কথা স্বীকার করেন পি কে হালদার। আর এসব টাকা তিনি ফিরিয়ে দিতে চান বলে জানান। এ জন্য কোনো ধরনের হয়রানি ছাড়া দেশে ফিরে এসে ব্যবসা পরিচালনা করার শর্ত দেন।
তবে বুধবার হাইকোর্ট নির্দেশ দেন, পি কে হালদার বিমান থেকে নামামাত্রই গ্রেপ্তার করে তাঁকে উপযুক্ত আদালতে পাঠাতে হবে। পুলিশের মহাপরিদর্শক, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের প্রধান ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতি ওই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুবাই থেকে এমিরেটস এয়ারলাইনের একটি ফ্লাইটে (ইকে ৫৮২) ২৫ অক্টোবর সকাল ৮টা ১০ মিনিটে পি কে হালদারের দেশে ফেরার কথা ছিল।
জানতে চাইলে গতকাল অ্যার্টনি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আইএলএফএসএলের আইনজীবী মাহফুজুর রহমান জানিয়েছেন, নির্ধারিত তারিখে (২৫ অক্টোবর) পি কে হালদার দেশে আসছেন না। দুদক ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কে পৃথক মেইল করেছেন। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। যখনই আসুন, আইন অনুযায়ীই সব হবে।
মেইল গতকাল পেয়েছেন বলে জানান দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের (আইএলএফএসএল) আইনজীবী মাহফুজুর রহমান আমাকে জানান, পি কে হালদার আসছেন না বলে আইএলএফএসএলকে মেইল করেছেন। মেইলের কপি আমাকে পাঠিয়েছেন। এতে করোনার মতো উপসর্গ আছে উল্লেখ করে এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে পি কে হালদার আসছেন না উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, আসার তারিখ ও সময় পরে জানাবেন। এটি আদালত অবমাননার শামিল মনে করি। এ ছাড়া কোনো পরীক্ষার রিপোর্ট ও চিকিৎসকের সনদ ছাড়াই ওই মেইল দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি দুদককে অবহিত করা হয়েছে এবং মেইলটি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হবে।’
মেইলের কপি আমাকে পাঠিয়েছেন। এতে করোনার মতো উপসর্গ আছে উল্লেখ করে এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে পি কে হালদার আসছেন না উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, আসার তারিখ ও সময় পরে জানাবেন। এটি আদালত অবমাননার শামিল মনে করি।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে পাঠানো চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন পি কে হালদার। ওই টাকা দিয়ে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যাওয়ার কথাও জানান। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনেও বেরিয়ে আসে, পি কে হালদার কমপক্ষে ২৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে টাকা বের করেছেন। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ১ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা ঋণের সুবিধাভোগী তিনি।
পি কে হালদার যেসব প্রতিষ্ঠানের মালিক বলে স্বীকার করেছেন সেগুলো হলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে, মার্চেন্ট ব্যাংক হাল ক্যাপিটাল, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ও আলিফ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট, ব্রোকারেজ হাউস কেএইচবি সিকিউরিটিজ। এর বাইরে শেয়ারবাজারের কোম্পানি নর্দান জুট, রহমান কেমিক্যালও তাঁর বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া কক্সবাজারের নির্মাণাধীন র্যাডিসন ব্লু হোটেলে তাঁর ৭০ শতাংশ শেয়ার থাকার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি আজিজ ফাইবার, আনন কেমিক্যাল, হাল ট্রাভেল (হাল ট্রিপ), হাল টেকনোলজি ও রেপটাইল ফার্ম তাঁর মালিকানাধীন বলে জানান পি কে হালদার।