কর্মপাগল মানুষ ছিলেন তিনি
আমার পরম সৌভাগ্য যে আমি মুহিত স্যারের মতো একজন অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধীনে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এতে স্যারের স্নেহ–ভালোবাসা যেমন পেয়েছি, তেমনি কীভাবে উচ্চ পেশাদারত্বের সঙ্গে জনস্বার্থ রক্ষায় নীতি সিদ্ধান্ত নিতে হয় তা দেখেছি। যেমন একসময় সভরেন বন্ড ছেড়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাংলাদেশের ঋণ সংগ্রহের বিষয়ে গঠিত কমিটি, উন্নয়ন অংশীদার ও বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সবাই এককাট্টা হলেও অনেক স্বল্প সুদের আপাত আকর্ষণীয় প্রস্তাবটি একমাত্র স্যারের কারণে আর এগোয়নি। শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালে মুহিত স্যারের সেই দূরদৃষ্টির প্রখরতা ও গভীরতা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
বহুবিধ কাজ একতালে ও লয়ে সম্পন্ন করায় পারদর্শী ছিলেন মুহিত স্যার। ৮০ বছরের বেশি বয়সে এসেও অনেক ধরনের কাজ একই গতিতে সুচারুভাবে সম্পন্ন করার অসীম দক্ষতা ছিল তাঁর। তাঁর মেধার স্ফুরণ দেখে প্রায়ই মুগ্ধ হতাম। মনে পড়ে, একদিন ৩০০ থেকে ৪০০ পৃষ্ঠার একটা পলিসি পেপার স্যারকে পৌঁছে দিলাম নিজ হাতে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেটা ফিরে এল আমার ডেস্কে। দেখি শত শত পৃষ্ঠার পেপারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লাল কালিতে বিভিন্ন মন্তব্য। একই সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন চারটি বিভাগের প্রচুরসংখ্যক নথির নিষ্পত্তিও করেছেন। স্যারের এ ধরনের ঈর্ষণীয় ও সহজাত প্রতিভা অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করেছি।
বাজেট–বক্তৃতার খসড়া প্রণয়নের অতিগোপনীয় কাজে কম্পিউটারে টাইপের কাজ করছি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বক্তৃতার বিভিন্ন অংশ স্যার সংযোজন ও বিয়োজন করে পাঠাচ্ছেন। আর আমরা টাইপ–পুনঃটাইপ করছি। কাজের চাপে আমরা সবাই প্রায় বিধ্বস্ত। অথচ সকাল–সন্ধ্যা অবধি পরিশ্রমের পরও স্যারের কিন্তু ক্লান্তি নেই। রাত ১১টার দিকে হবে। কম্পিউটার থেকে মুখ ঘুরিয়ে পেছন ফিরে দেখি মুহিত স্যার। আমাদের অনুপ্রাণিত করতে এসেছেন। কিছু কিছু তাৎক্ষণিক সংশোধনী দিলেন। একপর্যায়ে নিজেই বসে গেলেন টাইপ করতে। আশ্চর্য রকমের কর্মপাগল মানুষ ছিলেন মুহিত স্যার। আরেকবার কোনো একটা নথিতে ফুটনোটে অতি ছোট অক্ষরে ওইসিডি দেশগুলোর নাম উল্লেখ ছিল। যখন নথি ফেরত এল, তখন দেখলাম ফুটনোটে ৩৮টি দেশের মধ্যে যে ১টি দেশের নাম বাদ পড়েছিল, তা লাল কালিতে উল্লেখ করে দিয়েছেন।
স্যার যে আমার প্রতি কতটুকু স্নেহপ্রবণ ছিলেন, তার দুটো নমুনা দিয়ে শেষ করব। সময়টা ২০১০ সাল। আমি তখন যুগ্ম সচিব। আমার হার্টে স্ট্যান্টিং হয়েছে। দীর্ঘ ছুটি শেষে অফিসে ফিরেছি। নথিতে আমার স্বাক্ষরযুক্ত কোনো একটি প্রস্তাব সচিব হয়ে স্যারের কাছে গেছে। প্রস্তাব অনুমোদিত হয়ে ফেরত এসেছে। তাতে দেখি নিচের দিকে স্যার লিখেছেন, ‘ওহ্, মুসলিম ফিরে এসেছে! তাকে দেখতে চাই।’ চোখে পানি এসে গেল। দৌড়ে গেলাম স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। এই মানুষটিই আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় আবুল মাল আবদুল মুহিত স্যার। অবসরের পরও তিনি আমাদের স্নেহের পরশ থেকে বঞ্চিত করেননি। গত বছর একদিন হঠাৎ আমার অফিসে হাজির। আমি হতবাক, বাকরুদ্ধ। কী বলব, আর কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। স্যার শুধু বললেন, ‘মনে হলো তোমাকে দেখে আসি, চলে এলাম’। স্যারের মৃত্যুতে আমি হারালাম একজন প্রকৃত অভিভাবককে আর জাতি হারাল একজন দেশপ্রেমিক কর্মবীরকে।
মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সাবেক অর্থসচিব