এক মাসেও কাটবে না গ্যাস–সংকট
টার্মিনালে ত্রুটির কারণে বন্ধ ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ। শেভরন সংস্কারকাজ শুরু করায় স্থলেও কমেছে উৎপাদন।
গ্যাসের চুলায় রান্না নিয়ে এক মাসের বেশি সময় ধরে ভুগছে নগরবাসী। নিবু নিবু আগুনে সীমিত রান্নায় পার করতে হচ্ছে দিন। শিল্পকারখানার অবস্থাও প্রায় একই রকম। যেটুকু পাচ্ছে, তা দিয়ে কারখানা চালু করা দায়। পরিবহনে গ্যাস দিতেও হিমশিম অবস্থা। এর মধ্যেই গ্যাসের সরবরাহ আরও কমেছে। আগামী এক মাসে কাটবে না গ্যাস-সংকট।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন-পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, ডিসেম্বরের শুরু থেকেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি কমেছে। সরবরাহ নেমে এসেছে অর্ধেকে। গ্যাসের উৎপাদনে চাপ কমে আসায় সম্প্রতি বিবিয়ানায় সংস্কারকাজ শুরু করেছে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। এ কাজ আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে শেষ হতে পারে। এটি বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় উৎপাদন ক্ষেত্র।
বিবিয়ানার ওপর একক নির্ভরতা দীর্ঘদিনের। এলএনজি ব্যয়বহুল। তবু গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়া হয়নি। আরও আগেই এগুলো ভাবা উচিত ছিল।
গ্রাহকদের সতর্ক করে সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি তিতাস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, কারিগরি কারণে তিতাসের আওতাধীন ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ১২ থেকে ২১ জানুয়ারি গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করবে। তবে তিতাসের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলছেন, তিতাসের কারিগরি কোনো বিষয় নয়, গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে।
পেট্রোবাংলা বলছে, দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুটের মতো। কয়েক মাস আগেও ৩২০ থেকে ৩৩০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা গেছে। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। এতে বিদ্যুৎ, সার কারখানা, সিএনজি স্টেশন, আবাসিক, শিল্পকারখানা—সব খাতেই গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে সিএনজি স্টেশন দিনে চার ঘণ্টা বন্ধ রাখা হচ্ছে। এক খাত থেকে কমিয়ে আরেক খাতে সরবরাহ বাড়িয়েও (রেশনিং) পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে নোঙর করা ভাসমান দুটি টার্মিনালের (এফএসআরইউ) মাধ্যমে দিনে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা আছে। গত ১৮ নভেম্বর বিকেলে সামিটের টার্মিনালের মুরিং লাইন ছিঁড়ে যায়। মুরিং হলো একটি স্থায়ী কাঠামো, যেখানে কোনো জাহাজ বাঁধা অবস্থায় থাকে। টার্মিনালে জমানো এলএনজি থেকে ১০ দিন পর্যন্ত সরবরাহ করে সামিট। এরপর থেকে সরবরাহ বন্ধ। বর্তমানে এটি মেরামতের কাজ চলছে। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এটি চালু করা হবে বলে লিখিতভাবে জানিয়েছিল সামিট। তবে আরও এক সপ্তাহ বেশি সময় লাগতে পারে বলে সম্প্রতি মৌখিকভাবে ধারণা দিয়েছে কোম্পানিটি। এ টার্মিনাল বন্ধ থাকায় দিনে ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা কমে গেছে। অন্য টার্মিনাল দিয়ে দিনে বর্তমানে ৫০ থেকে ৫৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে।
এলএনজি আমদানি করে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। এ কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার কথা সামিটের। আগামী মাসের জন্য এলএনজি আমদানি করতে দরপত্রের প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে কয়েক বছর ধরেই দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন কমছে। একসময় দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন করা হলেও বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ২৩০ কোটি ঘনফুটের মতো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করে শেভরন। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুটের মতো করে উৎপাদন করে আসছিল তারা। এখন দিনে ১১৫ থেকে ১২০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন করা হচ্ছে। দিনে ১০ কোটি ঘনফুটের মতো উৎপাদন কমে গেছে।
জানতে চাইলে শেভরনের কমিউনিকেশন ম্যানেজার শেখ জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সর্বোচ্চ উৎপাদন ধরে রাখার বিষয়ে শেভরন সব সময় তৎপর আছে। বিবিয়ানার পশ্চিম ও উত্তর প্রান্তে সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে। এ সময়ে গ্যাসের চাপ একটু কমতে পারে।
একসময় দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন করা হলেও বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ২৩০ কোটি ঘনফুটের মতো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করে শেভরন। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুটের মতো করে উৎপাদন করে আসছিল তারা। এখন দিনে ১১৫ থেকে ১২০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন করা হচ্ছে। দিনে ১০ কোটি ঘনফুটের মতো উৎপাদন কমে গেছে।
পেট্রোবাংলা বলছে, বিবিয়ানায় উৎপাদন কমে গেলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। তাই উৎপাদন কমানো প্রতিরোধ করতে শেভরন গ্যাস উৎপাদনের টিউব পরিবর্তন করে আরও বড় ব্যাসের টিউব বসাচ্ছে। এটি শেষ হলে উৎপাদনের স্বাভাবিক মাত্রা ধরে রাখা যাবে। পেট্রোবাংলার পরামর্শে তিন ভাগে ভাগ করে কাজটি করছে শেভরন, যাতে একসঙ্গে উৎপাদন বেশি না কমে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্যাসের চাপ কম থাকার অভিযোগ করেছেন বাসিন্দারা। তিতাসের অভিযোগ কেন্দ্রেও দুপুর পর্যন্ত অনেক অভিযোগ এসেছে। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পাইকপাড়া, রামপুরা, হাতিরপুল, যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি, কল্যাণপুরসহ শহরের অধিকাংশ এলাকার বাসায় গ্যাসের সমস্যা দেখা গেছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, একটি টার্মিনালে আকস্মিক দুর্ঘটনায় এলএনজি সরবরাহ কমেছে। নিয়মিত সংস্কারকাজের আওতায় রক্ষণাবেক্ষণ শুরু করেছে শেভরন। এর ফলে কোথাও কোথাও গ্যাস কম পাওয়া যাচ্ছে। তবে সর্বোচ্চ সরবরাহের চেষ্টা চলছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক সহকারী ম. তামিম প্রথম আলোকে বলেন, বিবিয়ানার ওপর একক নির্ভরতা দীর্ঘদিনের। এলএনজি ব্যয়বহুল। তবু গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়া হয়নি। আরও আগেই এগুলো ভাবা উচিত ছিল। এ মুহূর্তে জরুরি কিছু করারও নেই রেশনিং ছাড়া।