অর্থনীতির গেম চেঞ্জার–৪৩
ঘরে বসে বাজার ও একজন জিয়া আশরাফ
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকে ভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এ সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথ রচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তারাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।
সময়টা ছিল ২০১৩ সাল। তিন বন্ধু মিলে খুব ছোট পরিসরে শুরু করেছিলেন চালডাল ডটকম। এখন এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার পণ্য ডেলিভারি করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। নামটাও অনেকের কাছেই পরিচিত—কথা বলছিলাম চালডাল ডট কমের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা, জিয়া আশরাফের।
যেভাবে হলো শুরু
ছোটবেলার বন্ধু ওয়াসিম আলীম বাংলাদেশে পড়াশোনা করে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে একটা বিলিয়ন ডলার কোম্পানিতে কাজ করছিলেন। একদিন জিয়াকে জানালেন, দেশের জন্য কিছু করতে চান। নিজেরাই কিছু করা যায় কি না, জিয়াকে আইডিয়া দিতে বললেন। তারপর একসময় চলে এলেন বাংলাদেশে। এরপর জিয়ার আরেক বন্ধু তেজশ বিশ্বনাথও যুক্ত হলেন। তিনজনেরই ব্যবসা করার ইচ্ছা। কিন্তু কীভাবে শুরু করবেন, কী দিয়ে শুরু করবেন, কিসের ব্যবসা করবেন—কিছুই ঠিক নেই। ২০১৩ সালে জিয়া নিজেই বনানীর বাসার পাশে এক মুদিদোকান থেকে মুদিপণ্যগুলো বাসায় এনে এনে ছবি তুলে ওয়েবসাইটে দিতে শুরু করলেন। সে বছরের ২ জুলাই প্রথম অর্ডার এল, তখন জিয়া নিজেই ডেলিভারি করতেন। এভাবে ধীরে ধীরে গুদাম ভাড়া নিতে হলো জিয়ার, আর কর্মী বাড়তে থাকল।
জিয়া আশরাফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন শুরু করলাম, তখন অনলাইন দোকান মানুষের কাছে পরিচিত নয়, তার ওপর আবার বাসার কাছের পণ্য অনলাইনে কেনার কথা তো চিন্তাই করতে পারত না কেউ! সবার কাছেই মনে হলো, এটা বোকামি ছাড়া কিছু না। কিন্তু আমরা তখন নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখে ফেলেছি।’
রিকশাচালকের মুখে পাওয়া নাম
শুরু হলো একটা ভালো নামের খোঁজ। মাথায় তখন নানা ধরনের নাম ঘুরপাক খাচ্ছে, এ বাজার-ও বাজার ডটকম নিয়ে ভাবছে তারা, কিন্তু কোনোভাবেই মন ভরছিল না তাদের। এমন একটা নাম খুঁজতে লাগলেন, যেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। ভাবতে ভাবতেই গেল বেশ কিছুদিন।
একদিন জিয়া রিকশায় করে বাজার করতে যাচ্ছিল। রিকশাচালক বলে বসলেন, ‘মামা চালডালের দাম বেড়েছে, আমাকে দশ টাকা বাড়াইয়া দিয়েন।’ তখনই জিয়ার মাথায় ঢুকে গেল চালডাল ডটকম, মনে হলো এই নামটাই সেরা। তখন বন্ধু ওয়াসিমকে জানালেন। তখন থেকেই নাম হয়ে গেল চালডাল ডটকম।
ছেড়ে ছিলেন চাকরি
কলেজ পেরিয়ে জিয়া ভর্তি হয়েছিলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে। পড়াশোনা করেছেন বিপণন নিয়ে। তখন থেকেই ভিন্ন কিছু করার ইচ্ছা ছিল। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যোগ দিলেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। তারপর একটা তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি নিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা সেখানে ভালোভাবেই কাজে লাগছিল জিয়ার। দুই বছর চাকরি করলেন। সে সময় জিয়ার মা অসুস্থ হলেন। তাঁকে নিয়ে যেতে হবে ভারতে। থাকতেও হবে দুই-তিন মাস। অফিস এত দিন ছুটি দিতে রাজি হলো না। তখন চাকরিটা ছেড়েই দিলেন জিয়া।
কেন নায়ক হইনি
জিয়ার বাবা বাংলা চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় নায়ক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জল। অনেকেই প্রশ্ন করেন, বাবার পথ ধরে তিনি কেন রুপালি জগতে নাম লেখালেন না? জিয়া বলেন, ‘নায়ক আমি কখনোই হতে চাইনি। বাবাও কিছু চাপিয়ে দেননি। বাবা শুধু পর্দার নায়ক নন, আমার কাছে সত্যিকার নায়ক। আমার শিক্ষক। সব সময় তিনি পথ দেখিয়েছেন। বলতেন, পড়াশোনা শেষ করে যেটা ভালো লাগে, সেটাই করবে। এই যে সততার সঙ্গে ব্যবসা করছি—এটা দীক্ষা তো বাবাই দিয়েছেন। আমার স্ত্রী তানজিনা ফেরদৌস, মেয়ে জুনেহেরা—ওদের নিয়ে আমার পরিবার।’
৮৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ
৮৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ পেয়েছে চালডাল ডটকম, যা দিয়ে সারা দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরে ছড়িয়ে চালডালের কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। চালডালের নতুন এ বিনিয়োগে প্রধান বিনিয়োগকারী লন্ডনভিত্তিক আর্থিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওয়াইজের সহপ্রতিষ্ঠাতা টাভেট হিনরিকাস, তরুণ প্রতিভাবানদের সহায়তাকারী প্ল্যাটফর্ম টপিকার মুখ্য পণ্য কর্মকর্তা স্টেন টামকিভি এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এক্সপ্লোরেশন ক্যাপিটাল। এর সঙ্গে আরও আছে বাংলাদেশি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান মীর গ্রুপ।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর চালডাল যুক্তরাষ্ট্রের ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠান ওয়াই কম্বিনেটর ও ফাইভ হানড্রেড স্টার্টআপের সহায়তা পেয়েছে। নতুন উদ্যোগ হিসেবে স্টার্টআপ বাংলাদেশের বিনিয়োগ পেয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর চালডাল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও আইডিএলসির বিনিয়োগ পেয়েছে।
চ্যালেঞ্জ ও ইকোসিস্টেম তৈরি
প্রতিনিই জিয়া আশরাফদের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। ক্রেতা কোনো পণ্যের সমস্যা কথা জানালে সঙ্গে সঙ্গে পণ্যটি বদলে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এমনও দেখা গেছে, মাছ রান্না হয়ে যাওয়ার পর অভিযোগ এসেছে, সেই মাছও বদলে দিয়েছে তারা। এমন চ্যালেঞ্জ প্রতিদিনই নিতে হয়। তা ছাড়া আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ সঠিক সময়ে পণ্য পৌঁছে দেওয়া।
এই মুহূর্তে পুরো ইকোসিস্টেম তৈরি রয়েছে চালডাল ডটকমের। তথ্যটি তুলে ধরে জিয়া আশরাফ বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই আমাদের রাইড শেয়ারিং চালাও অ্যাপ চালু করেছি। ফুড ডেলিভারি সার্ভিস কুকআপস তৈরি করেছি। সামনে আমরা অনলাইন ফার্মেসি বাংলামেডস ও লেনদেনের সহজ মাধ্যম চালডাল পে চালু করতে যাচ্ছি। চালডালের যে ইকোসিস্টেম তৈরি হয়েছে, এখন আমরা দেশের বাইরে সহজেই কাজ করতে পারি। কিন্তু এই মুহূর্তে দেশেই আরও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’
ঢাকার বাইরে চালডাল
এই মুহূর্তে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও যশোরে চালডালের ২৫টি পণ্যগুদাম আছে। এ ছাড়া কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি পণ্যগুদাম ও যমুনা সেতুর রেলওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের আবাসিক এলাকায় একটি সুপারশপ রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার অর্ডার ডেলিভারি করে। এ বছর দেশের অন্তত ১৫টি নতুন শহরে ৫০টিরও বেশি পণ্য গুদাম স্থাপনের পরিকল্পনা আছে।
করোনার আগে ও পরে
করোনার আগে চালডাল দৈনিক আড়াই থেকে তিন হাজার অর্ডার ডেলিভারি দিত। করোনায় সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ হলে অনলাইনে নিত্যপণ্যের কেনাকাটা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২০ সালে চালডালের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩০০ শতাংশ। এ বছর চলাচল সহজ হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত চালডালের ১২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
চালডাল আর জিয়া একই সুতোয় বাঁধা। ফলে নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা মানে চালডালকে নিয়েই স্বপ্ন দেখা। জিয়া আশরাফ জানালেন, ‘সেই স্বপ্ন থেকেই বলতে চাই, চালডাল ডটকম ই-কমার্স সাইটগুলোর রোল মডেল হিসেবে দাঁড়াতে চায়।’
জিয়ার যন্ত্রজীবন
শৈশব কেটেছে ঢাকায়। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ভালোবাসেন জিয়া। এমনকি বাজারে কোনো নতুন ফোন এলে আগে সেটির ফিচারগুলো দেখা, কীভাবে এই ফোনের মধ্যে চালডাল ডটকমের অ্যাপটি আরও সহজভাবে নকশা করে ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছানো যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকাই ছিল জিয়ার কাজ। সব সময় নিজেকে হালনাগাদ রাখাটা জরুরি বলে মনে করেন তিনি। জিয়া আশরাফ বলেন, ‘অনেকে ভাবেন লোকদেখানোর জন্য নতুন ফোন ব্যবহার করি। কিন্তু নতুন ফোন ব্যবহার করা শুধু জানার জন্য। প্রতিদিনই প্রযুক্তি পরিবর্তন হচ্ছে। সফটওয়্যার, অ্যাপ এমনকি জীবনযাপনও পরিবর্তন হচ্ছে। যেহেতু আমি একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, তাই এর সঙ্গে থাকাটা আমার শখ ও চ্যালেঞ্জ।’
দেশে–বিদেশে ঘোরাফেরা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, গান শোনা, নতুন নতুন কলম সংগ্রহ করা ছিল জিয়ার শখ। এ তালিকায় আরও আছে গেম খেলা। দাবা, সিম সিটি আর ভাইস সিটি গেম বেশি খেলেন। এ ছাড়া বাচ্চাকে সময় দিতে আর গাড়ি চালাতেও পছন্দ করেন তিনি।